টানা ৩৯ দিন ধরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ এই সময়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতিই হয়নি। তার শরীরের অভ্যন্তরে থেমে থেমে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্তক্ষরণের এ ঝুঁকি এড়াতে দেয়া হচ্ছে ইনজেকশন। বার বার রক্তক্ষরণের উৎস খুঁজতে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে ক্যামেরাযুক্ত ক্যাপসুল। যেটি সেবন করিয়ে পরিপাকতন্ত্রের প্রকৃত রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হবে। চিকিৎসকরা এটাকে বলছেন, ‘ক্যাপসুল এন্ডোস্কপি’। এমন তথ্য জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার পরিবার, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
জানা যায়, ক্যাপসুল এন্ডোসকপি পরিপাকতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি ভিটামিন সাইজ ক্যাপসুল সেবনের মাধ্যমে রোগীর পারিপাকতন্ত্রের (মুখ থেকে পায়ুপথ) চলমান ও স্থির ছবি সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। ভিটামিন সাইজের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এই ক্যাপসুলের মধ্যে রয়েছে একাধিক ক্যামেরা, লাইট, ব্যাটারি এবং তথ্য সংরক্ষণকারী ডিভাইস। পরিপাকতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের গতানুগতিক পদ্ধতির (এন্ডোসকপি ও ক্লোনোসকপি) মাধ্যমে যখন উপসর্গের কারণ নির্ণয় করা যায় না, তখন ক্যাপসুল এন্ডোসকপি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বড় ধরনের রক্তক্ষরণের ঝুঁকি এড়াতে তাকে ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। তার শরীর এতটাই দুর্বল যে, কথা বলতেও কষ্ট পাচ্ছেন। জটিল এমন শারীরিক অবস্থায় বিবেচনা করেই গত সপ্তাহে ক্যাপসুল এন্ডোস্কপি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য বিদেশ থেকে কামেরাযুক্ত ক্যাপসুল আনা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাপসুল এন্ডোস্কপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসক বলেন, এটি মুখে খাওয়ানো হয়। ওই ক্যাপসুল শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থিরচিত্র তুলতে থাকে, যা কম্পিউটারে দেখতে পান চিকিৎসকরা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা পায়ুপথের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। প্রতি সেকেন্ডে কয়েকটি ছবি তুলতে সক্ষম এই ক্যাপসুল। সাধারণত বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে। এর আগে বাংলাদেশে খুবই স্বল্প পরিসরে এর ব্যবহার হয়েছে।
সূত্রমতে, গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে বোর্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী (এএফএম সিদ্দিকী) প্রথমবারের মতো জানান, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। উনার মেসিভ রক্তক্ষরণ হয়েছে। তিনি মৃত্যু ঝুঁকিতে আছেন। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর থেকে খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতাল ভর্তি হন। সেই থেকেই চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতালের হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিক্যাল বোর্ড তার চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন। এই বোর্ডে এভারকেয়ার হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রয়েছেন। ৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের এক সদস্য বলেন, গত ৭ ডিসেম্বর রাত থেকে বেগম জিয়ার আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়, পরদিন তা আরো বাড়ে। এরপর থেকে থেমে থেমে রক্তপাত হচ্ছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের ভারসাম্য বজায় রাখতে মাঝে মাঝে তাকে রক্ত দিতে হয়।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা তাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তার যে ধরনের চিকিৎসা দরকার সেই প্রযুক্তি বাংলাদেশে নেই। তাই তাকে দ্রুত বিদেশে পাঠানো হলে সুচিকিৎসা সম্ভব।
তিনি বলেন, ৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। প্রতিদিনই মেডিকেল বোর্ড বসে তার চিকিৎসা কী হবে তা ঠিক করছেন। স্বাস্থ্য পর্যালোচনা করে প্রতিদিনই ওষুধ দিচ্ছেন তারা। রক্তক্ষরণ বন্ধে তাকে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। এর আগে ১৩, ১৭, ২৩ ও ৩১ নভেম্বর বড় ধরনের রক্তক্ষরণের কারণে বিএনপি প্রধান মারাত্মক মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে গত ২৪ নভেম্বর চিকিৎসকরা তার এন্ডোস্কপি ও কলোনস্কোপি করেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের চিকিৎসায় খালেদা জিয়ার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। বরং তার শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি ততই বেড়ে যাচ্ছে। এখন তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার এই চিকিৎসা শুধু বিশ্বের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতেই সম্ভব। এখনই চিকিৎসা দিতে না পারলে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
এভারকেয়ার হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, খালেদা জিয়ার এখন পর্যন্ত পাঁচবার বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়েছে। প্রতিবারই তিনি মারাত্মক মৃত্যুঝুঁকিতে ছিলেন। রক্তক্ষরণ হলে শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, তিনি উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেন। রক্তবমির কারণে তার খাওয়া দাওয়ায় অনীহাও বেড়েছে। মাঝে মধ্যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হলেও আবার কখন শুরু হয়, তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত থাকেন। কারণ, থেমে থেমে এই রক্তক্ষরণ অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর ফলে যে কোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তাকে বিদেশ পাঠাতে চিকিৎসকরা সুপারিশ করলেও তাতে কর্ণপাত করছে না সরকার। এতে প্রমাণিত হয় এই সরকার খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে দিতে চায় না। এখন তাকে জীবন থেকেও সরিয়ে দিতে চায়। তারা দেশে বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ