রাজনৈতির মাঠে বিরোধী দল না থাকায় আওয়ামী লীগের মুখোমুখি অবস্থানে এখন আওয়ামী লীগই। নৌকার প্রতিপক্ষ নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। কেন্দ্রীয় আওয়ামী কঠোর হুঁশিয়ারির পরও থামানো যাচ্ছে না তাদের। বিএনপি না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন। দলীয় কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যন্ত। একে অন্যের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। ঘটছে মৃত্যুও। প্রায় পাঁচশ’র মতো সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন। আগামী চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সহিংস ঘটনার বেশির ভাগই নিজেদের মধ্যে। দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে এমপি লীগ বা ভাই লীগ। আদর্শের চেয়েও বড় হয়ে পড়েছে পদ-পদবি। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতার এই সিংহাসন চাইছে সব পক্ষ। ফলে প্রকট হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। মুখোমুখি অবস্থান হলেই জড়িয়ে পড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষে। ঘটছে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেছনে কলকাঠিও নাড়ছেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনি মাঠে না থাকায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বাড়ছে। নির্বাচনি মাঠে প্রতিপক্ষ থাকলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকতেন। এখন প্রতিপক্ষহীন নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগই। সহিংসতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবার লক্ষ্য একটাই— যেভাবেই হোক নির্বাচনে জয়লাভ। ফলে সংঘর্ষ বাড়ছে। এটা দুশ্চিন্তার কারণ। নির্বাচনে হানাহানি বা প্রাণহানির মতোর ঘটনা ঘটুক— এটা আমরা চাই না।
অবশ্য তারা এও বলছেন, বিদ্রোহী প্রার্থী সবাইকে বহিষ্কার করতে গেলে দল দুর্বল হয়ে পড়বে। দলে বিভক্তি বাড়বে। আর বিপুলসংখ্যক দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়াও কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে ভুল প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ থাকে। তখন যোগ্য ও দলের নিবেদিত অনেকে হয়তো বিদ্রোহী হন। এসব বিদ্রোহীকে দল থেকে বের করে দিলে তৃণমূলে চিড় ধরবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় ‘নৌকার মনোনয়ন পেলেই পাস’। এ চিন্তাধারা থেকেই প্রার্থীরা জনমুখী না হয়ে মনোনয়নমুখী ও প্রশাসনমুখী হচ্ছেন। ফলে তৃণমূলে রাজনৈতক দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে ‘নৌকা’ পাওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। এমপিরাও একই কাজ করছেন। সবমিলিয়ে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভে অনেক নেতাই বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। আবার প্রার্থী পছন্দ না হলে এমপি, জেলা নেতারা নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। দিন শেষে ক্ষতি হচ্ছে লীগের, নষ্ট হচ্ছে চেইন অব কমান্ড।
জানা গেছে, নেতাদের কাজে লাগিয়ে রাজাকার পরিবারের সদস্য, বিএনপি নেতা, খুনের আসামিসহ নানা অপকর্মে জড়িতরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বা পদ পাচ্ছে। আগামী নির্বাচন ও কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আসছে বিষয়টি। এই সংকট সামনে আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে। যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটা অশনিসংকেত। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের ভেতরেই এমপি বা ভাই লীগ দমাতে উভয় সংকটে রয়েছে দলের হাইকমান্ড।
দলের সিদ্ধান্ত কী তা দেখার সময় নেই এমন ভাব তৃণমূল নেতাদের। নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিদ্রোহীদের ওপর হামলা করছেন। বিদ্রোহীরাও পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। ফলে সহিংসতা বেড়েই চলছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন নির্বাচনি সহিংসতায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৮ জন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছেন ৮ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন আরো ৬৪ জন। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত ইউপি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ সহিংসতাই লীগের নিজেদের মধ্যে। এতে আহত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির দুইজন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন। তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন সাতজন ও পরবর্তী সহিংসতায় ছয়জন নিহত নিয়ে মোট মারা গেছেন ৯৮ জন। চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার ও কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ৬৭ বার। এতে আহত হয়েছেন প্রায় ৫০০ জন। নিহত হন আটজন। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩২১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন।
আসকের সাধারণ সম্পাদক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, দিন দিন আদর্শিক রাজনীতি দূরে চলে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দলগুলোর ভেতরে আরেকটি দল, নানা উপদল সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের কারণে। আর সে স্বার্থ নিয়েই দলের নানা উপদল অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
প্রথম ধাপে ২৮৬ ইউপিতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল শতাধিক। দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮ ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল ৮৯৭ জন। তৃতীয় ধাপে এক হাজার সাত ইউপিতে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ৬৯ জন। চতুর্থ ধাপে ৫৬০ ইউপিতে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৪০ জন। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের হুমকি দিয়েও বিপাকে দলের হাইকমান্ড। প্রায় হাজার খানেক নেতাকর্মী যারা ইউপিতে বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বহিষ্কার করতে হবে দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে। আবার চাইলেই কাউকে বহিষ্কার করা যাচ্ছে না। কারণ দলের হাইকমান্ড, এমপি-মন্ত্রীদের তদবির, কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুরোধের কারণে গণহারে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না শীর্ষ নেতৃত্ব। এ নিয়ে ধীরগতি নীতিতে চলছে দলটি। তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে ৫২৫টিতে। আর হেরেছে ৪৮৩টি ইউপিতে। দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের জয় ৪৮৬টি। আর বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩৪৮টিতে জয়লাভ করে। প্রথম ধাপে ২০৪ ইউপির মধ্যে ১৪৮ নৌকা ও ৫৬ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত চার ধাপের ভোটে তিন হাজার ৪০টি ইউপিতে ২৯৬ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। প্রথম ধাপে ৭১ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৭৭, তৃতীয় ধাপে ১০০ এবং চতুর্থ ধাপে ৪৮ চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট ছাড়াই জয়লাভ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, আর্থিক প্রলোভনসহ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিদ্রোহীদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। তাদের কথা, বিএনপি নির্বাচনে নেই। তাই দলীয় প্রার্থী হলেও ছাড় দেয়া হবে না। ভোটে যা হয় হবে। আর এই কারণে উত্তেজনা এবং সহিংসতাও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কথাও শুনছেন না কেউই। কারণ এমপিরা তাদের নিজেদের লোকদের মনোনয়নের ব্যবস্থা করেছেন। জেলা-উপজেলা নেতারা কেন্দ্রে যোগ্য জনপ্রিয় প্রার্থীদের নাম পাঠাননি। টাকার বিনিময়ে অনেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। রাজাকার পরিবারের সন্তান, হত্যা মামলার আসামি, নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত, চাল চোর, গম চোর, ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ, বিএনপি-জামায়াত নেতারা দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। তাই এসব দুর্নীতিবাজদের কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি না তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা। কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের কথাও শুনছেন না বিদ্রোহী প্রার্থীরা। আবার অনেক ইউপিতে এমপি ও জেলা নেতাদের প্রশ্রয়ে বিদ্রোহী হয়েছেন অনেক পদধারী নেতারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া আছে। সুতরাং, কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিতে হয়। চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে নেয়া যায় না। তবে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা করে বা সংঘর্ষে জড়ায়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, আমরা সব প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলছি। যারা বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন তারা যেন দলের পক্ষে কাজ করেন সেজন্য বলা হচ্ছে। আমরা কাউকে বহিষ্কার করতে চাই না। সবাই দলের লোক। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেব।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এরকম পরিস্থিতির কারণে কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই। ইউপি নির্বাচনে আমরা দেখছি এবারো অনেক আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছেন। এতে দলের ক্ষতি হচ্ছে। নিজেরা মাঠ দখলের জন্য অন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক কথা বলছেন অনেকেই। এগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং যারা বিদ্রোহী রয়েছেন তারা যেন নির্বাচনে না দাঁড়ায় সেজন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ