গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের একটি বয়কট করে ও দুটিতে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়ে টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দীর্ঘ এই সময় ধরে দলটির রাজনীতি কার্যত নানা ধরনের ব্রিফিংয়ের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে। এর সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রায়ই বিএনপিকে ‘ব্রিফিং পার্টি’ হিসেবে টিপ্পনী কাটে।
২০১৯ সালের নির্বাচনের পর মাঠের রাজনীতিতেও দলটি বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। এমনকি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আটক হওয়াকে কেন্দ্র করেও রাজপথ উত্তপ্ত করতে পারেনি বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ব্যস্ত ছিলেন নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করাতে। আর দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন বিবৃতি দিয়ে। সবমিলিয়ে ‘ব্রিফিং পার্টি’র তকমা লাগে বিএনপির সঙ্গে। এখন সেই তকমা মোছার চেষ্টা শুরু করছে দলটি।
নিজেদের সুসংগঠিত করে ফের মাঠে সক্রিয় হওয়ার দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে দলটির কার্যক্রমে। মানববন্ধন, সেমিনারের পাশাপাশি প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সভা-সমাবেশ। প্রতিটি সমাবেশেই নেতাকর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে ব্যাপক হারে। আগামী দিনে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আরো বাড়ানোর একগুচ্ছ পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন এমন তথ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার পতনের আন্দোলন কথা বললেও শুধু স্থায়ী কমিটির বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন আর প্রেস ব্রিফিংয়ে আটকে আছে বিএনপির রাজনীতি। আর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বার বার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে দলটি। মাঠ পর্যায়ে কোনো সক্রিয় কর্মসূচি না থাকায় ঝিমিয়ে পড়ছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ডিআরইউ ছাড়া বিএনপিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। জনগণ সম্পৃক্ত কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় না। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবেই ভুগছেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে দলটির সমর্থক এখনো রয়েছে। হামলা-মামলা ও বয়সের ভারে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতারা হারিয়ে যাচ্ছেন। এসব কারণে প্রতিটি পদক্ষেপে পরাজয় ঘটছে বিএনপির।
জানা গেছে, বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া বিএনপি হঠাৎ রাজপথে সক্রিয় অবস্থান নেয়ায় মাঠ পর্যায়েও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি মাসে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির দুটি সভায় এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ সেখানে যে কোনো ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলটি নির্বাচন নয়, আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আর এর জন্য ঢেলে সাজানো হচ্ছে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলে আনা হবে নতুন নেতৃত্ব। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিএনপির সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলো নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ সব জেলা, মহানগর, বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হবে। এমনকি জাতীয় কাউন্সিল করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
দলীয় সূত্রমতে, মাঠের হতাশা কাটিয়ে উঠতে রাজধানীতে ৬ দিনব্যাপী তৃণমূলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন দলটির শীর্ষনেতারা। গত এক মাসে দলের নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ১০ দিন বৈঠক করল বিএনপি। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকগুলো ছিল বেশ দীর্ঘ, যা গড়ে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মতো। ১০ দিনের বৈঠকে প্রায় ৪ শতাধিক নেতা বক্তব্য দেন। অতীতে এ ধরনের বৈঠকগুলোতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে খুব কমসংখ্যক দলীয় নেতা এবং পেশাজীবী কথা বলতেন।
মাঠপর্যায়ের নেতারা তাদের বক্তব্যে দলের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণে মতামত দিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ভার্চুয়ালি প্রতিদিন তৃণমূলের বক্তব্য শুনেছেন। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি বাণিজ্য নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন বিএনপি নেতারা। তারা দলীয় হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ করেন, এসব সংগঠনের বিভিন্ন কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেন এবং স্বজনপ্রীতি হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে তৃণমূলের সিংহভাগ নেতারাই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পরামর্শ দেন।
কারণ হিসেবে তারা বলেন, যেখানে ভোটাররাই ভোট দিতে পারে না, সে নির্বাচনে যাওয়া অর্থহীন। বৈঠকে জোট রাজনীতি নিয়েও অধিকাংশ নেতা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, বিএনপির অসম্পূর্ণ সব ওয়ার্ড-ইউনিয়ন, থানা-উপজেলা, পৌর ও সাংগঠনিক জেলা কমিটি গঠন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্দোলনমুখী নেতৃত্বে এসব কমিটি গঠন করতে হবে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সাংগঠনিক জেলার সব ইউনিটের কমিটি গঠনের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটি গঠনে কারো গাফিলতি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত ১২ অক্টোবর রাতে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী নয়া শতাব্দীকে বলেন, সরকার গণতন্ত্রকে সংকুচিত করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে আর কোনো স্পেস নেই। সরকার যেভাবে অত্যাচার করেছে তাতে শুধু বিএনপি নেতাকর্মীই নন, সাধারণ জনগণও রক্ষা পাননি। নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জোর করে অধিকার হরণ করে রেখেছে সরকার। আর কত নিষ্পেষিত হবে? এবার প্রতিরোধের পালা। প্রতিরোধ করেই জনগণ সংকুচিত গণতন্ত্রকে বিস্তৃত করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নয়া শতাব্দীকে বলেন, অত্যাচার-নির্যাতন যত বাড়ে মানুষের মাঝে মোকাবিলার চিন্তা তত বেশি জাগ্রত হয়। রাত যত গভীর হবে সকাল তত সন্নিকটে। অন্যায়-অত্যাচারে ছেয়ে গেছে দেশ। তিনি বলেন, সরকারের সিরিজ নির্যাতন আমাদের সয়ে গেছে। ১৪টি বছর অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে লড়াই করছি। সরকারের নির্যাতন আরো যত বাড়বে ততই আন্দোলন জোরদার হবে। আমাদের নেতাকর্মীদের পিছু ফেরার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের নেত্রীকে অন্যায়ভাবে আটক রাখা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে সরকার বৈষম্যের রাজনীতি করছে। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নেই, বাকস্বাধীনতা নেই। এ রকম নানা কারণে জনমনে অসন্তোষ আছে। তাই জনগণ বিএনপির নেতৃত্বে রাজপথে সরব হতে চায়।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ