ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ‘ভিন্ন কৌশলে’ মাঠে নেমেছে বিএনপি। দলের অনেক নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভোটের মাঠে থাকছে তাদের কর্মী-সর্মথকও। বিশেষ করে যেসব ইউপিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশি কিংবা যেসব ইউপিতে আগে থেকে বিএনপি ও সমমনা দলের ভোট বেশি সেখানেই প্রার্থী সংখ্যা বেশি বিএনপির।
ইতোমধ্যে গণসংযোগও শুরু করেছেন তারা। যদিও দলীয় সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি। এ কারণে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের মাঠে থাকার সুযোগ পাননি কেউ। বিএনপির একাধিক সূত্র বিষয়টি নয়া শতাব্দীকে নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের সময় বেশকিছু শঙ্কা মাথায় রেখেছিল শীর্ষ নেতৃত্ব। তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। নীতি-নির্ধারকদের শঙ্কা ছিল বিএনপি নির্বাচনের মাঠে না থাকলে আওয়ামী লীগ নিজেরাই কোন্দলে জড়াবে। আওয়ামী লীগের মধ্যকার সেই কোন্দলও তুমুল পর্যায়ে পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন দলটির প্রতীক নৌকা পাওয়া বা সমর্থন আদায় নিয়ে তাদের মধ্যে রক্তারক্তি অবস্থা। কয়েকজন মারাও গেছে। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তাদের কোনো প্রার্থী মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে মোকাবিলা করতে কিছুটা হলেও ঐক্যবদ্ধ থাকত। সব মিলিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বরং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বিএনপি।
নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোটকেন্দ্রবিমুখ হয়ে পড়ে ভোটাররা। এই অবস্থায়ও বিএনপি কয়েকটি উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। ভোটের দিন প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারা, ভোটকেন্দ্রিক নানা মামলা-হামলার শিকার হতে হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফলে অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তিও হারিয়েছে, যা নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল করে দেয়।
দলীয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের মার্চ মাসে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। এরপর থেকেই কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি দলের কোনো প্রার্থী। বরং দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় সিলেট-৩ উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় শফি আহমদ চৌধুরীকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে ইউনিয়ন ও উপজেলা এবং পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির হাইকমান্ডও অনেকটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। ধানের শীষ প্রতীক ছাড়া কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তার ব্যাপারে দল বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে না। এই সিদ্ধান্তের পর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করছেন। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অনেকে ভোটের মাঠে ছিলেন। জয়লাভও করেছেন অনেকে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা কঠোর হলেও যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন, তাদের ফেরানো যেত না। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে খবর হতো তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকেই প্রার্থী হয়েছেন। এই সুযোগ কেন দিব? কিছু নেতাকর্মী আছে সব সময়ই বিদ্রোহী, আবার কিছু নেতাকর্মীর নির্বাচন করার রোগ আছে। তবে যারা জয়লাভ করবে হয়তো তারা দলে ভালোভাবেই থাকবেন। তবে যারা পরাজিত হবেন, তাদের দলীয় পদ-পদবি থাকা কঠিন হবে।
জানা যায়, যেসব ইউপিতে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী রয়েছে সেখানে বিএনপির তৎপরতা কিছুটা কম। তবে যেখানে ক্ষমতাসীনদের একাধিক প্রার্থী রয়েছে সেসব ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে বেশি সক্রিয় তারা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জনের কৌশলে তারা মাঠে নেমেছেন। তবে এসব নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করছেন তার কোনো তালিকা দলের কাছে নেই। এ নিয়ে কোনো আগ্রহও নেই। গণমাধ্যমের খবর বলছে, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে সারাদেশে পাঁচ শতাধিক ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
বিএনপির মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচন না করায় দারুণ চাপে পড়বে সরকার। বিএনপি ছাড়াও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। এ কারণে দেশি-বিদেশি মহলের কাছে এর জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।
তারা আরো বলেন, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় রাজনীতি এক নয়। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও স্থানীয় পরিস্থিতির কারণে সব জায়গায় তা শতভাগ বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। স্থানীয় প্রভাব ও জনগণের চাপে অনেকে প্রার্থী হতে বাধ্যও হতে পারেন। তবে ইউপি নির্বাচনে কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন তা নিয়ে আমরা ভাবছি না।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের কাউকে অংশ নিতে আমরা যেমন জোর করব না, তেমনি কেউ স্বতন্ত্রভাবে ভোট করতে চাইলে বাধাও দেবো না। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন পরিচালনা, প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করাসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে আমরা বিরত আছি। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের পরও অনেক এলাকায় কেউ কেউ স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন। কেন তারা নির্বাচন করছেন তা দলীয়ভাবে জানতে চাওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, সারাদেশে দলের লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে। এখন কোনো সমর্থক যদি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে আমরা কীভাবে তাকে বিরত রাখি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না এটা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত। তার পরও দলের কেউ যদি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। সুতরাং নির্বাচনে অংশ নিয়ে তো লাভ নেই। যতদিন পর্যন্ত সরকারের পরিবর্তন না হবে, ততদিন পর্যন্ত বিএনপি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে যাবে না।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ