রাজপথ কিংবা সংসদ, কোথাও শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আইনের জালে ও সরকারের বেধে দেয়া শর্তে দীর্ঘ দিন রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অপরদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন ধরে আছেন লন্ডনে। এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলের প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত শুধু বৈঠকের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
‘আন্দোলন নাকি সংলাপ’ দাবি আদায়ের কৌশল হিসেবে কোনটিকে বেছে নেবে বিএনপি? নাকি ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার’ দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে দুটি অস্ত্রই ব্যবহার করবে দলটি। এমন প্রশ্নে বেশ দোটানায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
তবে দলের দায়িত্বশীল শীর্ষ নেতারা জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটা জোরালো ও শক্তিশালী আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। তবে এক দফা দাবি আদায়ের আলোচনার দরজাও খোলা থাকবে। অনেক নেতাই আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের পক্ষে নন। আবার কেউ কেউ বলছেন, সরকারকে শেষবারের মতো সুযোগ দিতেই আন্দোলনের পাশাপাশি সংলাপের দুয়ারও খোলা রাখা দরকার।
তারা আরো বলছেন, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ে ডান-বাম সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে একটি প্ল্যাটফরমে একত্র করতে চায় বিএনপি। এ ব্যাপারে দলের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। অভিন্ন দাবিতে প্রথমে দলগতভাবে আদর্শভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দেবে নাকি আগে সংলাপের দিকে যাবে তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তবে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সংলাপেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন দলের অনেকে নেতা। যদিও ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে সংলাপের দাবি আগেই নাকচ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। কোনো সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারছেন না দলটির নেতারা। এমনকি অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি দলটি। বারবার কৌশলের কথা বললেও সেই কৌশলেরই বলি হচ্ছেন নেতারা। তাই দ্রুত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠনের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। নইলে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলটির আন্দোলন বা সংলাপ কোনোটাই সুফল আসবে না।
বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যেহেতু এখনো দুই বছরের বেশি সময় বাকি রয়েছে। তাই তাড়াহুড়া করে কোনো আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা আপাতত নেই নীতিনির্ধারকদের। তবে ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একটি রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছে বিএনপি। ইতোমধ্যে রূপরেখার একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। একই সাথে ভবিষ্যতে আন্দোলন কর্মসূচিতে দলের নেতা-কর্মীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং দলীয় ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করতে কাজ করে যাচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোয় পুনর্গঠন কাজ চলছে। এরপরই এক দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামবে বিএনপি। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যখন দলের ভেতর সরকার পতন আন্দোলনের চাপ বাড়ছে তখন আলোচনার সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু নয়া শতাব্দীকে বলেন, আলোচনার কী আছে। আমরা কি এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, যখন তাকে গদি থেকে সরানো হয়েছে। অতীতে যে আলোচনা আমরা তার সুফল তো পাইনি বরং এই আলোচনার জন্য আজ আমাদের এই অবস্থা। তাই এ অবস্থায় আন্দোলনের বিকল্প নেই।
একই বিষয়ে বিএনপির আরেক ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু নয়া শতাব্দীকে বলেন, আলোচনার দরজা খোলা থাকবে। কিন্তু, আন্দোলনের প্রস্তুতি থাকবে। অতীতে দেখেছি, আন্দোলন হয় তবে কোনো সুফল আসে না। এর ফলে বঞ্চিত হয় জনগণ, বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। এবার আমরা আর কালক্ষেপণ করব না।
তিনি আরো বলেন, এক দফা দাবি আদায়ের রূপরেখা ঠিক করতে লন্ডন থেকে সর্বস্তরের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানেও সিংহভাগ নেতা মত দিয়েছেন একদফা আন্দোলনের পক্ষে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আ ন হ সাইফুল ইসলাম জানান, এই দেশের জনগণ চায় একটা যুগপৎ আন্দোলন। গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলন। বিএনপি একটি শক্তিশালী দল। আমরা একটা জোরালো, শক্তিশালী আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছি।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য রবিউল আলম রবি নয়া শতাব্দীকে বলেন, আলোচনা প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে একটা স্মুথ এক্সিটের সুযোগ হবে। এটা যদি আওয়ামী লীগ লুফে নেয় তবে সেটা আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো। আর এটি যদি তারা না করে তবে একটা দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে যাচ্ছে। নইলে কঠোর আন্দোলনের মধ্যে এ সরকারকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ নির্বাচন সম্পন্ন করতে বাধ্য করা হবে।
বিএনপিপন্থী ঘরনার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন, বিএনপি এখনো বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারেনি। এখন তারা যদি সব বিরোধী দলকে বোঝাতে পারে যে ক্ষমতায় গেলে তারা সুশাসন দিতে সক্ষম, তাহলে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে আন্দোলনে সাফল্য পেতে পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে, বিএনপির নেত্রী বিশেষ ব্যবস্থায় নিজ বাসভবনে আছেন। আওয়ামী লীগ এটাকে চাল হিসেবে ব্যবহার করবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। কারণ তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এই সরকার নির্বাচন নিয়ে খেলা করে গত দুই মেয়াদ ক্ষমতায় আছে। দেশে বর্তমানে নির্বাচনের কোনো পরিস্থিতি নেই। আগে সরকারকে পতন করতে হবে তারপর নির্বাচন যাবে বিএনপি।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ