একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ‘২০ দলীয় জোট’ ও ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নিয়ে কার্যত আর সামনে এগোতে চাইছে না বিএনপি। জোটের শরিকদের সরাসরি ‘না’ না বললেও যারা বেরিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি দলটি।
এরই মধ্যে জোট থেকে একে একে বেরিয়ে গেছে ইসলামি ধর্মভিত্তিক দলগুলো। এখন বাকি শুধু জামায়াত। এ দলটিও নিজ থেকে বেরিয়ে গেলে বিএনপি ‘খুশি’। গত তিন বছর ধরে জোট দুইটি অকার্যকর। জোটভিত্তিক কোনো কর্মসূচিও পালন করছে না বিএনপি। আগামী দিনের কোনো কর্মসূচির কথাও বলতে পারছেন না জোটের নেতাকর্মীরা। এমনকি জোট নিয়েও বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জানা নেই শরিকদের। সব মিলিয়ে জোট রাজনীতি নিয়ে রীতিমতো নিশ্চুপ বিএনপি।
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত দেশে ও বহির্বিশে^ আগের ‘ক্লিন ইমেজ’ ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবেই ‘ধর্মভিত্তিক দলের জোটে’র তকমা এড়াতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কৌশলি হয়েছে বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদে নির্বাচনে প্রতিবেশী দেশসহ পশ্চিমাদের আস্থা অর্জনে দলটি এখন কার্যত জোটবিমুখ।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা দাবি করেছেন, ২০ দল ভাঙার পেছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে। ‘সরাসরি সরকারের চাপ প্রয়োগের কারণেই জোট ত্যাগের ঘটনা ঘটছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে দুর্বল করতে বিকল্প আরেকটি জোট গঠনের তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে জোট ছাড়ার ঘটনা ওই প্রক্রিয়ার অংশ। বড় দল হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির একক সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। সেখানে ক্ষোভ বা হতাশার কিছু নেই। ঠিক তেমনি জোট ছাড়ার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও অধিকার রয়েছে।
নেতাদের মতে, শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করলেই কেবল জোটের রাজনীতি সক্রিয় হবে এবং প্রয়োজনে কর্মসূচি আসবে। দলের সাংগঠনিক তৎপরতা জোরেশোরে চলছে বলে সম্মিলিত রাজনৈতিক কার্যক্রমও স্থগিত আছে যা বিএনপির একক শক্তির উত্থানের সঙ্গে যুক্ত। ‘একলা চলো নীতি’তে চলছে চাইছে বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা। তবে জোট দুটোর নেতাদের দাবি, জোটের কর্মসূচি ও বৈঠক থেকে দূরে অবস্থান নিয়ে মূলত একা থাকতে চাইছে বিএনপি। বিএনপির ‘একলা চলো নীতি’তে চলার কারণে জোটের এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ নির্বাচনের পর নানা ইস্যুতে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একক সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আড়াই বছরে মাত্র কয়েকটি বৈঠক করেছে। ভবিষ্যতে জোট রাখবে কিনা-বিএনপির কাছে জানতেও চেয়েছেন শরিকদের কেউ কেউ।
সদ্য সমাপ্ত সিরিজ বৈঠকেও একব্যক্তিকেন্দ্রিক দল ও নেতার সঙ্গে জোট বাঁধার বিপক্ষে মত দিয়েছেন বিএনপির বেশিরভাগ নেতা। তারা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে থেকে জামায়াত নিজের স্বার্থে আওয়ামী লীগের নৌকায়ও ভোট দিতে দ্বিধা করবে না। বহির্বিশে^র কাছে দলের সঙ্গে লেগে থাকা ‘ধর্মভিত্তিক’ ট্যাগ আর বইতে চায় না। এদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বন্ধুশূন্য হচ্ছে বিএনপি। একইভাবে গণফোরামও মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান স্বীকার করেন না, তার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেন না। এ জোট আন্দোলনের মাঠে কোনো কাজে আসবে না। ‘ওয়ান ম্যান শো’ দলগুলোর সঙ্গে জোট করে কোনো লাভ হবে না। বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলনের ডাক দিতে হবে। আন্দোলনে যা কিছু করার দরকার সবই দলের নেতাকর্মীদের করতে হবে।
জানা গেছে, ২০ দলীয় জোট থেকে সর্বশেষ বিএনপি জোট ছাড়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। এর আগে কওমি আলেমদের পুরোনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালে বিএনপি জোট ছেড়ে যায়। আর শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও অনেক আগে। বিএনপি জোটে প্রথম ভাঙন ঘটে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় জোট ত্যাগ করে শেখ শওকত হোসেন নীলুর ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। ২০১৮ সালের জাতীয় ঐক্য গঠন করলে বেরিয়ে যায় জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মোর্তুজা নেতৃত্বাধীন এনডিপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জোট ত্যাগ করেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। এদিকে, নির্বাচনের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছিল এ ফ্রন্ট। কিন্তু নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের পর ধীরে ধীরে অনেকটা অকার্যকর হয়ে গেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণা কাটাতে বিএনপি কয়েক বছর ধরে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে ভবিষ্যতে সরকার পতনে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গঠনের কথাও বলছে বিএনপি। সরকারবিরোধীদের সঙ্গেও চলছে আলোচনা।
ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জোটে ভাঙন হলেও ছেড়ে যাওয়া দলগুলোর মূল অভিযোগ বিএনপির ওপর। দলগুলোর দাবি, ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রেখেছে বিএনপি। শরিকদের সঠিক মূল্যায়ন না করা। দৃশ্যমান রাজনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসূচি নেই। একইসঙ্গে ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ২০ দলীয় জোটকে কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। এ ক্ষোভই শরিকদের জোট ত্যাগের বিষয়টি ত্বরান্বিত করেছে।
এদিকে জোটের আরেক শরিক কল্যাণ পার্টি ও অলি আহমদের এলডিপিও ২০ দলীয় জোটে আর থাকতে চাইছে না, তা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে চলছে আলোচনা। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ার দাবি জোরালো হয়েছে বিএনপিতে। সম্প্রতি দলের ধারাবাহিক বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারেক রহমানের সবুজ সংকেত রয়েছে এ ব্যাপারে। এখন শুধু চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মতামতের অপেক্ষায় দলটি। তবে বিএনপি চাইছে এর আগে জামায়াত নিজ থেকে চলে যাক। জোট ছেড়ে গেলেও তাতে জোটে দলের সংখ্যায় কোনো হেরফের হয়নি। কারণ, যখনই কোনো দল জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে, তখনই দলের অন্য একজন নেতার নেতৃত্বে একাংশ একই নামে আলাদা দলের ঘোষণা দিয়ে ২০ দলে থেকে গেছেন।
বিএনপি সূত্রমতে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোনো জোটকেই প্রাধান্য না দেয়ার। বিশেষ করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে একমঞ্চে রেখে যে কোনো কার্যক্রমেই অনীহা রয়েছে দলটির। একইসঙ্গে চলমান ধারাবাহিক বৈঠকেও তৃণমূল নেতারাও জামায়াত ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। জোটগত রাজনীতির প্রয়োজন ফুরিয়ে না গেলেও এতে নতুনত্ব আনার পক্ষে বিএনপি। আর এ কারণে জোট ত্যাগ করলেও বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য থেকে বিরত রয়েছেন।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপি জামায়াত নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই জোট ভেঙে যাচ্ছে। তারা জামায়াতকে ডেকে বের করে দিতেও পারছে না। ফলে বিএনপির পক্ষ থেকে জোটরক্ষার জন্য কোনো তৎপরতা বা উদ্যোগ নেই। জোটকে নিষ্ক্রিয় করে রাখছে। তাই জোটের কার্যক্রম নেই বলেই শরিকরা ছেড়ে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে।
জোটের শরিকরা কেন বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোট স্থবির হয়ে পড়েছিল। এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার পর ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মূল্যায়ন অনেকাংশে কমে গেছে। সব মিলিয়ে দুই জোটের মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারেনি বিএনপি। ফলে আস্তে আস্তে আরো অনেকেই বেরিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের নিয়ে গেছে বিএনপি। সেই সংলাপেও ২০ দলীয় জোটের কোনো শরিককে নেয়নি। অথচ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। তারা আন্দোলনেও শরিক ছিলেন। মোটকথা ২০ দলীয় জোটের কোনো কর্মকাণ্ড নেই।
জোট ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, কিছু দল হতাশায়, কিছু দল চাপে পড়ে জোট ছাড়ছে। এভাবে কিছু দল যাবে, কিছু দল থাকবে। যারা থাকবে, তাদের নিয়েই কাজ করতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। জোট ছাড়ার স্বাধীনতাও রয়েছে। স্বতন্ত্র দল হিসেবে যে কোনো দল যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি তাদের দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদি কোনো দলে মনে করে তারা ২০ দলীয় জোটে থাকবে না, সেই স্বাধীনতা তাদের আছে। তিনি বলেন, মূলত আমরা অনেক রাজনৈতিক দল একটি লক্ষ্য নিয়ে জোটবদ্ধভাবে এগিয়ে গিয়েছিলাম। এখন তারা যদি মনে করে জোটের প্রয়োজনীয়তা নেই, তাহলে ছেড়ে যেতেই পারে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। দীর্ঘদিন ধরে জোট নিষ্ক্রিয় এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, শরিরকরা সবাই তো জোটের একটি অংশ। তাহলে তারা কেন কাজ করেনি। জোটে আমরাও (বিএনপি) একটি পার্টি, তারাও একটি পার্টি। এখানে সবারই কাজ করার অধিকার রয়েছে। নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা জোট ছাড়ছে, এটা কারণ হতে পারে না।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ