ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এ সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৪ অগস্ট থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রশ্নে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি জানান। তিনি বলেছেন— অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, তারা একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এ সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে, জনগণের আস্থা আছে। তবে অবশ্যই এটা (নির্বাচন) সীমিত সময়ের মধ্যে, একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এছাড়া নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপের দাবিও জানিয়েছে দলটি।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তাদের পূর্ণ সমর্থন জানায় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারা বলেছেন— ‘যেসব মৌলিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, সেগুলোকে ট্র্যাকে আনতেই হবে। আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠুভাবে সেই কাজ সম্পন্ন করবে।’ কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার দুই সপ্তাহ পর বিএনপির ভোট নিয়ে আলোচনার দাবির মধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয়ার দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর গত রোববার জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় গত সোমবার বিএনপির পক্ষ থেকে এক ধরনের আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনামুখর না হলেও তাদের প্রত্যাশা যে পূরণ হয়নি, নেতাদের বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট। ওইদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে রোডম্যাপ না থাকায় নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি বলে মনে করেন তিনি।
‘কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়’— জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের জবাবে সোমবার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, ‘এখনো একটা জিনিস ধোঁয়াশা, যেটা আমার পরিষ্কার হয়নি। যেটা আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন, গণতন্ত্রের পথে কীভাবে যাবেন, কিন্তু আমরা পাইনি। সংস্কারের কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কোন খাতে সংস্কার আনবেন, সে ব্যাপারে কিছু আভাস দিয়েছেন। আমি জানি, এত অল্প সময়ে সেটা সম্ভব নয়। তার পরও একটা ধারণা দিলে ধারণা করতে পারতাম যে ভালোর দিকে যাচ্ছে।’
ফখরুল ছাড়াও দেশকে আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফেরাতে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার যমুনায় আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টার ডাক পান বিএনপি নেতারা। সেখানে সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, তাদের মধ্যে অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেয় ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার। এরই পরিপেক্ষিতে গতকাল শনিবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠক শেষে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া চালু রাখবে। তারা যেসব সংস্কার প্রস্তাব দেবে তা সরকার গ্রহণ করবে।
বিএনপি নেতারা বলেন, ভোট ছাড়া, মানুষের ভোটিং পাওয়ার ছাড়া কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা জানা নেই। সেজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্রের ভাবনায় নির্বাচনের মুখোমুখি জাতিকে করতে হবে, জাতি ঠিক করে নেবে কার প্রয়োজন। এজন্য আমাদের ভালোবাসার এ সরকারকে বলব, মানুষের ভোটাধিকারটা দেন। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা না থাকলে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়। সে ধরনের প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার কাজে হাত দেয়া উচিত। আমরা মনে করি, সংস্কারের বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। তাই সরকারকে সুনির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে।
এর আগে গত ১২ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সরকারকে সময় দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলিনি। আগেও বলেছি, এটার জন্য কিছু সময় লাগবে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে। আমরা তাদের অবশ্যই সেই সময় দিচ্ছি। আমরা তাদের সব বিষয়কে সমর্থন দিচ্ছি।’
নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিচ্ছেন। এমন বক্তব্যের দুই সপ্তাহ পরে দ্রুত নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ প্রকাশের দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এতে করে জনমনে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কি এমন হলো যে দুই সপ্তাহ পরই বিএনপিকে ইউটার্ন নিতে হলো। অন্যদিকে এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, শহীদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। আহতরা হাসপাতালে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের চিন্তা দলের নেই।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আসলে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এক মাস পেরোয়নি। এ সরকারকে সময় দেয়ার ব্যাপারে আমাদের জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। যৌক্তিক একটি সময়ের মধ্যে তারা যাতে ভোটের ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের যে জরুরি কাজ যেমন আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এ ছাড়া যে জরুরি বিষয়গুলো রয়েছে সে ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র জনতা এবং আমাদের আন্দোলনের ফসল। স্বাভাবিক কারণে তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিকতা ভালোবাসা হূদ্যতা ও সমর্থন থাকবে।
একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য সময় দিতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে নির্বাচনের রোডম্যাপের কথা বলছেন; আসলে আপনারা কী চাচ্ছেন? জবাবে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, কাজ করতে হলে তো একটু পরিকল্পনা দরকার সেজন্য তারা প্রকাশ (রোডম্যাপ) করলে অসুবিধা হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য কোনো তারিখ দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী যেই সরকার গঠিত হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের সম্মান ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। প্রথম থেকেই এ সরকারকে আমরা সহযোগিতা করে আসছি এবং শেষ সময় পর্যন্ত তাদের সহযোগিতা করে যাব। এ সরকার কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছেন প্রয়োজনীয় সংস্কার করবেন তাতেও বিএনপির সম্মতি রয়েছে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে চলমান সংকট নিরসনে নির্বাচনের রোডম্যাপের কথা বলা হয়েছে। রোডম্যাপ ঘোষণা করলে সেভাবে সামনে আগানো সম্ভব হবে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ