ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘প্রশংসনীয়’ ভূমিকায় জামায়াত

প্রকাশনার সময়: ১২ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১৬

আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছে তরুণ প্রজন্ম। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর এমন শিক্ষার্থী-জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তীব্র আন্দোলন আর হয়নি। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ঢাকাসহ সারা দেশে বিজয় উল্লাস করে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। তবে এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা নানা জায়গায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উপাসনালয়, বাড়িঘর ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে জামায়াতের ভূমিকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসিত হচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এছাড়া আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি। দেয়া হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের পাশে দাঁড়াতে পেরে দলটির শীর্ষনেতাদের মধ্যেও উৎসাহ দেখা গেছে।

গত ৫ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উপাসনালয়, বাড়িঘর ও সম্পত্তির নিরাপত্তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো দুষ্কৃতকারী যেন দেশে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য দলীয় নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষকে সজাগ থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে দলমত নির্বিশেষ একটি সুন্দর দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

জামায়াত আমিরের এমন ঘোষণার পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঘুরপাক খায় দলটির নেতাদের মন্দির নিরাপত্তা ও পরিদর্শনের নানা ছবি। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, পুরান ঢাকার প্রাচীনতম জয়কালি মন্দির, রমনার সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, ডেমরা কেন্দ্রীয় মন্দির, কেরানীগঞ্জের মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারী, কিশোরগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের মন্দিরগুলো জামায়াতের নেতারা পরিদর্শন করেন এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। জামায়াত নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে প্রশংসিত হয়েছেন দেশের সব ধর্মের লোকদের কাছে। এমনকি মন্দিরগুলো পাহারা দিতে গিয়ে অনেক স্থানে তাদের ধর্মীয় ইবাদত পালনও করতে দেখা গিয়েছে।

জামায়াত নেতারা বলেন, একটি সুবিধাবাদী দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনা, প্রতিপক্ষের বাড়িঘর এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করছে। নেতাকর্মীদের এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে বলেছেন জামায়াত আমির। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যেখানেই দুর্বৃত্তপনা দেখবেন, তৎক্ষণাৎ এদের প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা কথা দিচ্ছি, বিদ্যমান প্রশাসনকে এ বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর উপাসনালয়, বাড়িঘরে হামলাসহ উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গত ৭ আগস্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বলা হয়, ছাত্র-জনতা ও আপামর দেশবাসীর প্রতি আমরা বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছি কোনো দুষ্কৃতকারী যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ওপর কোনো ধরনের হামলা যাতে না হয়, সে বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং সব রাজনৈতিক দলসহ জনগণকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জানমাল, উপাসনালয় ও ঘরবাড়ি রক্ষায় পাহারা দিচ্ছে। এই পাহারা আরও জোরদার করতে হবে। জামায়াত নেতারা বলেন, অতীতের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় জামায়াত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সারা দেশে দুর্বৃত্তদের দ্বারা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলার নিন্দা জানান তারা। কোনো দুষ্কৃতকারী যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে এ জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতা ও পাশে থাকার আশ্বাস দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। মন্দিরের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জামায়াত নেতাদের এমন কাজ ও উদ্যোগের জন্য তাদের প্রতি সন্তুষ্টি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। গত বুধবার রংপুরের পীরগঞ্জে জাফরপাড়ার বামনপুরে নিজ বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন তিনি। এর আগে তিনি আবু সাঈদের মা-বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান। এছাড়াও নিহতের পরিবারকে নগদ এক লাখ টাকা তুলে দেন। একই সঙ্গে আবু সাঈদের পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও জানান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এদিকে গত বৃহস্পতিবার কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়েছেন জামায়াত আমির। একই দিন রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেছেন তিনি। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, কোনো বাহবা বা রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির পাহারা দিচ্ছি না, মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকার জন্য আমরা এ কাজে নেমেছি। আপনাদের প্রয়োজনে জাতির প্রয়োজনে যদি কখনো জামায়াতকে অনুভব করেন সেটাই হবে আমাদের শ্রেষ্ঠ উপহার। তখন যেন আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া দিতে পারি।

এদিকে ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসা ব্যয় বহন করছে জামায়াতে ইসলামী। পাশাপাশি আন্দোলনে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে। গত বৃহস্পতিবার ফেনী প্রেসক্লাবে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন জেলা জামায়াতের আমির একেএম শামসুদ্দিন। তিনি বলেন, আজকের এ অবস্থানে আসতে অসংখ্য ছাত্র শহীদ হয়েছেন। তাদের সব সময় আমরা স্মরণ করব। এ সূর্য সন্তানদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানাব। দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায় তাদের পরিবারের জন্য একটি ভাতা প্রক্রিয়া চালু করার দাবি করছি। তাদের দেয়া সুন্দর পরিবেশ ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের।

গত শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মুহা. দেলাওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহতদের দেখতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যান। এ সময় দেলাওয়ার হোসেন বলেন, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যারা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আমরা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের দেখতে এসেছি। এখানে চিকিৎসাধীন যারা রয়েছেন তাদের সার্বিক খোঁজখবর আমরা নিয়েছি। অত্যন্ত নির্মমভাবে দেশের এসব মানুষকে নির্বিচারে গুলি করা হয়েছিল। আগুনে ঝলসে দেয়া হয়েছে। অনেককে রামদা দিয়েও কুপিয়ে জখম করা হয়েছিল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমরা এসব ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে রয়েছি। আমরা তাদের জন্য দোয়া করেছি অতি দ্রুত যেন মহান আল্লাহ তাদের সুস্থ করে দেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর উত্তরায় গুলিতে নিহত হন নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসিফ হাসান। নিহত আসিফ হাসানের কবর জিয়ারত করেন জামায়াতে ইসলামীর সাতক্ষীরা জেলার নেতারা। দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের আস্কারপুর গ্রামে আসিফ হাসানের বাড়িতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন জেলা জামায়াতের আমির হাফেজ মুহাদ্দিস রবিউল বাশার।

গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আন্দোলনে শহীদ আদিল (১৭) নামে এক শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি শহীদ আদিলের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করেন এবং পরিবারকে আশ্বস্ত করেন, যে কোনো বিপদাপদে পাশে থাকবেন এবং সার্বিক দেখভাল করবেন। শহীদ আদিল ছাত্রশিবিরের একজন কর্মী ছিল। সে তামিরুল মিল্লাত মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। কোটা আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকায় বাসার ছাদে খেলার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। এর পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রিয়া। এই পরিবারটির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও খোঁজখবর নেন নারায়ণগঞ্জ মহানগরী জামায়াত নেতৃবৃন্দ। এ সময় রিয়া গোপের মা ও তাঁর পরিবারের সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে অনুরোধ করেন মহানগরী জামায়াতের আমির আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, সব অন্যায় ও জুলুমের বিচার একদিন হবেই হবে।

চলমান ছাত্রজনতার আন্দোলনে ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগের’ হামলায় শহীদ সাকিবের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি শহীদ পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানান, আমিরে জামায়াতের পক্ষ থেকে নগদ এক লাখ টাকা প্রদান করেন এবং শহীদ সাকিবের জন্য দোয়া করেন।

কোটা আন্দোলনে ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগের’ হামলায় আহত মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র রায়হানের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি আহত রায়হানের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন, পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানান এবং তার দ্রুত সুস্থতা কামনায় দোয়া করেন। এ সময় তিনি আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে চিকিৎসাধীন রায়হানের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরী উত্তর জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। কোটা আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে নানান ধরনের কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোর দেখভাল এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাসা পাহারা দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সারা দেশে আমিরে জামায়াত ডা.শফিকুর রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী জামায়াত কর্মীরা উল্লিখিত কাজগুলো করছে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে।’

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ