বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে এখন পর্যন্ত জোরালো কোনো আন্দোলনে যায়নি দলের নেতারা। তার মুক্তি দাবীর বিষয়টি আটকে আছে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, অনশন ও মানববন্ধনে। এমনকি মায়ের মুক্তির জন্য লন্ডনে থাকা পুত্র তারেক রহমানও কোনো কঠোর বার্তা দেয়নি। অভিযোগ রয়েছে, খালেদাকে বন্দি রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় দলটি। এ কারণে তার মুক্তির বিষয়ে কঠোর আন্দোলনে যাওয়া হয়নি। শুধু সরকার পতনের একদফা দাবীতে অনড় রয়েছে দলের শীর্ষ নেতারা।
এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরে এক কক্ষে কাটছে খালেদা জিয়ার জীবন। কখোনো নাজিম উদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার, কখোনো আবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে এবং এছাড়া বাকী সময় কাটছে ফিরোজায়। এভাবেই বন্দী অবস্থায় কেটেছে তার ১৪টি ঈদ। অথচ এক সময় খালেদাকে ঘিরে নেতাকর্মীদের সরগরম উপস্থিতিতে মুখোরিত ছিল গুলশান কার্যালয়। সিনিয়র নেতারা বসে থাকতেন খালেদার নির্দেশের অপেক্ষায়। বিনিময়ে তারা লুটেছেন নানা ফায়দা। কিন্তু এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে তাদের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় খালেদা জিয়াকে। তাৎক্ষণিক নেয়া হয় সিসিইউতে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এখন ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না দলটির হাইকমান্ডদেরও। শুধু জানানো হয়েছে হাসপাতালে বাঁচার লড়াই প্রতিটি মুহূর্ত পার করছেন খালেদা জিয়া। সারা দেশের মানুষের কাছে চাওয়া হয়েছে দোয়া। শনিবার তাঁর অবস্থা আরও ‘ক্রিটিক্যাল’ হয় বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব। গতকাল তার হার্টে পেসমেকার বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা বোর্ডের এক সদস্য। এর আগে শনিবার রাতে দেশী-বিদেশী চিকিৎসকদের নিয়ে জরুরী একটি চিকিৎসা বোর্ড বসানো হয়।
দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, খালেদা জিয়ার দুঃসময়ে পাশে থাকেনি বিএনপির সাবেক এমপি-মন্ত্রীর কেউ। শেষ সময়ে খালেদা জিয়া একাই লড়ছেন। মায়ের মুক্তির জন্য বার্তা দেননি লন্ডনে থাকা পুত্র তারেক রহমানও। শুধু এমপি কিংবা মন্ত্রী নন, দলটির নানা অঙ্গসংগঠন, আইনজীবী, চিকিৎসক, রাজনৈতিক সহযোদ্ধারাও রহস্যজনক ভাবে চুপ। খালেদা জিয়া বন্দী হওয়ার পর আন্দোলন হয়নি, সাজা হওয়ার পরও আন্দোলন হয়নি, এখন মৃত্যুর পথযাত্রীর চিকিৎসা নিশ্চিতেও কোনো কার্যত আন্দোলন হচ্ছে না। দোয়া, মিলাদ মাহফিল, অনশন, স্মারকলিপি ও মানববন্ধন করে নরম অবস্থান থেকে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে মুক্তি দিতে। কিন্তু মুক্তি দিতে চাপ কিংবা বাধ্য করার মতো কর্মসূচি এখনো দলটি দেয়নি। অতীতে সামান্য ইস্যু হলেও বৃহৎ আন্দোলন ও ভূমিকা দেখাত দলটি। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে দীর্ঘ সময় হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ আন্দোলন করেছে দলটি। কিন্তু এমন ভূমিকা দেখা যায়নি দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তি ইস্যুতে। বিষয়টি নিয়ে কানাঘুসা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
সূত্রমতে, অসুস্থ খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি এবং তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করছেন। দলের শীর্ষ দুই জনের এমন পরিস্থিতির সুযোগে তারেক রহমানকে ভুল বার্তা পাঠানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বার্তা প্রেরকরা তারেক রহমানের আস্থাভাজন বলে পরিচিত। তারা বরাবরই খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী রেখে বিদেশীদের কাছে জুলুম-নির্যাতনের আভাস দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে দুর্নীতিবাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ফলে খালেদাকে বন্দী রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল থেকে বঞ্চিত হয়েছে দলটি। তারপরও তার মুক্তির বিষয়ে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দলের কিছু সিনিয়র নেতা তার মুক্তির বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা তুললেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি বলে দলের নিতি নির্ধারক সূত্রে জানা গেছে। এর আগে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর খালেদার মুক্তির বিষয়ে হাইকোর্টের সামনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিল থেকে সড়ক অবরোধ করা হয়। ভাঙচুর করা হয় বেশ কয়েকটি যানবাহনও। সংঘর্ষ হয় পুলিশের সঙ্গে। ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামী করা হয় নোমান-হাফিজসহ আরো অনেককে। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর ওই একটি ঘটনায় ঘটে বলে দলীয় সূত্র দাবী করে। যদিও ওই ঘটনার পর নোমান ও হাফিজকে তিরস্কার করা হয়। বর্তমান তারা দলে কোণঠাসা। কিন্তু তৃণমূলের কাছে তারা এখনো হিরো। বলা হয় রাজধানীর শীর্ষ নেতারা যখন খালেদার মুক্তির বিষয়ে নীরব, সেখানে ঢাকায় এসে বুইড়া হাড়ের ভেলকি দেখিয়েছেন নোমান।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ছবি, নাম ব্যবহার করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন কিংবা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নানা পদবী পেয়ে সুবিধা নিয়েছেন। মালিক হয়েছেন শত শত কোটি টাকার। এখন তারা সামান্য দাঁতব্যথা পেটব্যথা হলে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কের হাসপাতালে চিকিৎসা করছেন। বাড়ি-গাড়ি, মৌজ-ফুর্তি, ভোগ-উপভোগ সবই করছেন। কিন্তু খালেদার মুক্তির বিষয়ে তারা বরাবরই চুপ থাকছেন। এমনকি দলীয় ফোরামেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় তাদের অনিহা। অথচ ১৯৯১ সালের আগে তাদের কি সম্পদ, অর্থ ছিল তা কমবেশী দেশের মানুষ ভালোভাবেই জানে। সব কিছু ভোগ করার পরও তারা এখন নীরব কেন। এমন রহস্য দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের ভাবাচ্ছে। দলের একটি অংশ থেকে প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির হাই-কমান্ডের কারণেও কী আন্দোলন হচ্ছে না। দলের একটি অংশের দাবী, তারেক রহমান পুরো দলকে একমুখী করে ফেলেছেন। খালেদা জিয়ার অনুসারীদের দুর্বল করে ফেলেছেন। ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতাদের তিনি বেশী মূল্যায়ন করে বড় পদে বসাচ্ছেন। অবমূল্যায় করা হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের। খালেদার মুক্তির আন্দোলন না হওয়ার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন সিনিয়ররা। কারণ তাদের মতামতের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে দলের একাধিক সিনিয়র নেতা।
খালেদা পন্থী সাবেক দুই সংসদ সদস্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর গুলশান অফিস থেকে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনেককেই আউট করা হয়েছে। এ জন্য শেষ সময়ে এসে কেউ দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কাদা লাগাতে চান না। সবাই সম্মান নিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে চান। খালেদা জিয়ার বিষয়ে করণীয় কী সবাই জানলেও দলের দুই-একজন হাই-কমান্ডের কারণে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির দুর্বল ভূমিকার কারণে কারাগারে বন্দী অবস্থায় দলের নেত্রীকে ভুল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। যার জন্য এখন তার শরীরে অন্য ওষুধ আর কাজ করছে না। কিংবা ওষুধ দেয়া হলে অন্য জটিলতা বেড়ে যাচ্ছে। এটার দায় সরকার যেমন এড়াতে পারবে না তেমনি বিএনপির হাইকমান্ডও। কারণ খালেদা জিয়ার এই মুমূর্ষু অবস্থায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ শীর্ষরা বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। সবশেষ খালেদা জিয়ার বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, মেডিকেল বোর্ডের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ম্যাডামের চিকিৎসা চলছে। তাকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন চিকিৎসকরা। এর বেশী কিছু বলার নেই। তিনি এর আগে জানিয়েছেন লিভার ও কিডনি সমস্যা আরও জটিল হওয়ায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে তার চিকিৎসকরা শঙ্কিত। বিদেশে নেয়া ছাড়া এ দেশে ডাক্তারদের আর কিছুই করার নেই।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আব্বাস বলেছেন, ‘আমরা বোকার স্বর্গে বাস করেছিলাম, আমরা বুঝতেই পারিনি; খালেদা জিয়াকে মূলত জেলে নেয়া হয়েছে হত্যা করার জন্য।’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’। শনিবার বিকালে ম্যাডামকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তিনি সিসিইউতে আছেন। তার অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক এবং ডাক্তাররা এখন ভেতরে কাউকে যেতে দিচ্ছেন না।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ