বিএনপির রাজনীতিতে ত্যাগী কর্মীদের কদর কমে তলানিতে এসে ঠেকেছে। দলটির ত্যাগী কর্মীরা এখন চরম অবহেলার শিকার। ক্ষমতায় না থাকার কারণে এলাকার আধিপত্য নিয়ে বিএনপির অধিকাংশ নেতা কৌশলে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। অন্যদিকে যেসব নেতাকর্মী জীবন বাজি রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন, তারা এখন আন্দোলন করে মামলা-হামলায় জর্জরিত। এমন পরিস্থিতিতে যেমন পাশে পাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন মূল্যায়ন হচ্ছে না কমিটিতেও। এ কারণে রাজনীতি ছেড়ে তৃণমূলের অনেকে নেতাকর্মী স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বিকল্প পথ খুঁজছেন। অভিযোগ রয়েছে বড় নেতাদের প্রভাব ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না থাকায় এমন বেহাল দশা হয়েছে দলটির। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে ত্যাগীদের মূল্যায়ন চায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনে মূল্যায়ন না করার কারণে সক্রিয় অনেক নেতা রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কারণ বিএনপির রাজনীতি করে আগের মতো ত্যাগী নেতাকর্মীরা মূল্যায়ন পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের ইশারায় অদক্ষ ও দুর্বল নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় কমিটি। ‘ভাইয়া’ বলয়ের কারণে নিষ্ক্রিয়রা কমিটিতে নাম লিখিয়ে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করা হয়। এমন অবমূল্যায়নে দলের অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এখন ত্যাগীদের মূল্যায়ন চায় রাজপথের পরীক্ষিত তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এমন নেতারা জানান, নিজেদের জীবন বাজি রেখে দলীয় কর্মসূচি ভূমিকা রেখেছেন তারা। এমনকি আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবন্দি হওয়ার পর তাদের মামলা পরিচালনা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, কারাগারের খরচ সবকিছু বহন করতে হয়েছে পরিবারকে। এ কারণে বিরক্ত হয়ে হতাশায় অনেকে রাজনীতিবিমুখ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। অনেকে নিজের ব্যক্তিগত আর কর্মজীবনকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছেন।
বিএনপির ছাত্ররাজনীতি শেষে বিভিন্ন অঙ্গ ও সংগঠনের পদে যুক্ত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করেনি বলে অভিযোগ করছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতারা। ছাত্রদলের নেতাদের অভিযোগ— এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাগারই তাদের ঠিকানা। বিশেষ করে বিগত সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সরকারের আমলে রাজনীতি করতে গিয়ে ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দলীয় পদ না থাকলেও বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে খ্যাত ছাত্রদলের সাবেক নেতারা সভা-সমাবেশে সক্রিয়। অবশ্য কেউ কেউ ক্ষোভে অভিমানে রাজনীতি থেকে দূরত্বে থেকে কেবল বড় ধরনের সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এরই মধ্যে যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলেও অনেকেই পদবঞ্চিত হয়েছেন। সম্প্রতি বিএনপিতে কয়েকজন নেতার পদোন্নতি, ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারসহ নানা কারণে ভবিষ্যতে আশার আলো দেখছেন পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা। তারা বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলসহ অঙ্গ ও সংগঠনে যুক্ত হয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে চান। এজন্য পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতারা দলীয় পদ তথা সাংগঠনিক পরিচিতি চান।
এদিকে যুবদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের দাবিতে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও যুবদলের সাবেক নেতাকর্মীরা কয়েক দফা বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীরা যুবদলের বর্তমান কমিটিকে ‘ব্যর্থ, অযোগ্য, অকার্যকর ও রাজপথে নিষ্ক্রিয়’ আখ্যা দিয়ে যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি বাতিল করে রাজপথে সক্রিয় ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, বিএনপি জনগণের দল, জনগণ নিয়েই বিএনপি রাজনীতি করে। বিভিন্ন সময়ে দলের প্রয়োজনে অনেকেই পদ-পদবির বাইরে রাখা হয়েছে। অনেকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বহিষ্কার হয়েছেন। তবুও দলের প্রতি তাদের ভালোবাসা কমেনি। প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে তারা দলকে সুসংগঠিত রাখতে কাজ করেছেন। বিগত আন্দোলন ও নির্বাচনে তারা তার প্রমাণ দিয়েছেন। দলীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করা হবে।
জানা যায়, কর্মসূচিগুলোতে জনস্রোতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন গত বছরের ২৮ অক্টোবরের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক চাঙ্গা করেছিল। কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন সংশ্লিষ্ট কার্যকরী নেতারা আটক হওয়ায় তারা ঝিমিয়ে পড়ে। বাইরে থাকা নেতারা কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উদাসীন ছিল। অভিযোগ আছে, যোগ্যতা নয় লবিং করে পদ পাওয়া নেতারা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। অনেক নেতা আত্মগোপনের নামে একেবারেই নিরাপদ স্থানে ছিলেন। সংগত কারণে নির্বাচন ঠেকানোর কোনো আন্দোলনই হয়নি। নিজেরা আন্দোলনের মাঠে না থাকলে পালিয়ে থাকা নেতারা ভার্চুয়ালি বৈঠকগুলোতে নিজেদের দায় এড়াতে অসহযোগ আন্দোলনের মতো একটি হাস্যকর কর্মসূচিতে যেতে হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়ন করে। কারাগার থেকে বের থেকে বের হয়েই এসব নেতারা পদসর্বস্ব নেতাদের বিষয়ে কার্যকর কিছু করার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে। সংকট কাটাতে দাবি উঠেছে, সাবেক ছাত্রনেতা, তরুণ ও ত্যাগী নেতৃত্বকে সামনে আনার।
এদিকে দীর্ঘ চার বছর পর গত ২৪ জুলাই ছাত্রদলের ১১ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিএনপি। তারা হলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এজমল হোসেন পাইলট, ইখতিয়ার রহমান কবির, মামুন বিল্লাহ, জয়দেব জয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, বায়েজিদ আরেফিন, সহ-সাধারণ সম্পাদক দবির উদ্দিন তুষার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আজম সৈকত, আব্দুল মালেক, সদস্য আজিজুল হক পাটোয়ারী আজিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকী। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব নেতাকে নতুনভাবে বিএনপির নির্বাহী কমিটি বা অঙ্গ ও সংগঠনের কোনো পদে দেখা যেতে পারে বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালের ২২ জুন ছাত্রদলের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের তখনকার সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিনও ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতির পদ পেয়েছেন।
বিএনপির এক নেতা বলেন, বিএনপিতে অমুক বা তমুকের নামে গ্রুপিং হচ্ছে। এসব চলতে থাকলে দল দুর্বল হয়ে যাবে। যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, মামলা হামলায় জর্জিরিত তাদের মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর পদপদবির জন্য যেভাবে দৌড়ঝাঁপ চলছে। আন্দোলনের সময় এর কিছু ভূমিকা রাখলে সফলতা আসতো। ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হলে আন্দোলন সংগ্রামের সময় তারা দলের জন্য কাজ করবে।
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ