দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটিয়ে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো আর ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয়ার কৌশল নিয়ে এগুতে চাইছে দেশটির অন্যতম বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী।
দলটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে আরও যেসব ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো, বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল গত ৭ জুনের নির্বাচন বর্জন করেছে, তাদের মধ্যকার ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রেখে ‘স্বতন্ত্র’ বা পৃথকভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছে জামায়াত।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আওয়ামী লীগের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হটিয়ে ভোটের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা এককভাবে কোনো দলের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এ ইস্যুতে যেসব দল একমত, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই আমরা নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করে যাবো। এরপর জনগণ যদি চায় সবাই মিলে এগিয়ে যাক, তখন সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেবো।”
দলটির অন্যতম মুখপাত্র মতিউর রহমান আখন্দ বলেন, “এখনই সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলনের পরিকল্পনা আমাদের নেই। আমরা সরকারকে সময় দেবো এবং সামনের জন্য প্রস্তুতি নেবো।”
এদিকে রাজনৈতিক এমন বিশ্লেষণের মধ্যেই শনিবার (৩০ মার্চ) রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করেছে দলটি। যেখানে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিএনপির ইফতারেও অংশ নেন জামায়াতের আমীরসহ দলটির কয়েকজন নেতা।
অনেকেই মনে করছেন, এর মাধ্যমে গত নির্বাচনের আগে থেকেই একে অপরের সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে এনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি।
যদিও এখনই ‘এক মঞ্চে আসা’ কিংবা ‘জোট’ করার কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ কোনোপক্ষেরই নেই বলে জানিয়েছেন জামায়াত নেতারা।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, তার ধারণা জামায়াত এখন জনসংযোগ হবে এমন নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকেই বেশি আগ্রহী হবে।
তার মতে, “অনানুষ্ঠানিকভাবে হয়তো তারা এমন কর্মসূচিই হাতে নেবে, যেখানে মানুষের কাছে যাওয়া যায় এবং একই সঙ্গে বিএনপিকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে, সরকার বিরোধী আন্দোলনেও আছি।”
এর আগে আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। এরও আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সাজা এবং প্রায় এক দশক প্রকাশ্য রাজনীতিতে অনুপস্থিতি এবং সরকারের নানামুখী চাপে থাকার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই একটা অবস্থান দেখা যায় দলটির। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে এবং ২০০১ সালে জামায়াতকে জোটে নিয়েই সরকার গঠন করে বিএনপি।
মূলত গত প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দলটি নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কখনো বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করে রাজনীতি করে আসছিলো।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিচার শুরুর পর থেকেই প্রকাশ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা হতে থাকে দলটি।
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপির সঙ্গে মিলে বর্জন করলেও পরে বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক নানামুখী চাপে পড়ে গেলে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জোট থেকেই সরে আসে দলটি।
এবারের সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি সভা সমাবেশের অনুমতি পেতে থাকলে, তা নিয়েও তখন নানা প্রশ্ন ওঠে যে, হঠাৎ কেনো সরকার জামায়াতের প্রতি সদয় হলো? নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটে না থাকলেও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির অনুরূপ কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছিলো দলটি।
সম্প্রতি দলটির আমির শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দসহ অনেক নেতাই কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এরপর নতুন পরিস্থিতিতে দলের কৌশল কী হবে, তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে।
গত ১০ মার্চ ঢাকায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে মিছিলের কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে রাজপথের কর্মসূচিও পালন করে দলটি।
এ বিষয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এখন কোনো জোটে নেই। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যারা বর্জন করেছে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে। কেবল তো নির্বাচন হয়ে গেলো। আমরা এখন ইসলামপন্থী সংগঠন হিসেবে বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় হয়ে উঠবো।”
সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনো জোটে যাওয়ার বা কোনো আনুষ্ঠানিক মঞ্চে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই। বরং তারা নিজেদের মতো করেই রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চান বলেই জানান দলের অন্যতম এই শীর্ষ নেতা।
তবে দলটির অন্য নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিরোধী অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নিজেদের মতো কর্মসূচি পালন করলেও, বিএনপির মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো পুরোপুরি বর্জনের চিন্তা নেই জামায়াতের।
বরং সামনের উপজেলা নির্বাচনে দলের কিংবা দলের কোন নেতা ভালো অবস্থান যেখানে আছে, সেখানে কেউ প্রার্থী হতে চাইলে দল থেকে বাধা দেয়া হবে না বলেই জানা যাচ্ছে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “দীর্ঘদিন সরকার আমাদের কোণঠাসা করে রেখেছে। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন হয়েছে। এখন আমরা গণতান্ত্রিক পথেই সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজ চালিয়ে যাবো। সময় আসলে জনগণ যা চাইবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে জামায়াত তেমন সিদ্ধান্তই নেবে।”
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, জয়ের সম্ভাবনা আছে, এমন উপজেলাগুলোয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অঘোষিতভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, তার কাছে মনে হচ্ছে জামায়াত ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে সংগঠনকে গোছানো এবং তার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে সামনের দিনগুলোতে।
তিনি বলেন, “অনেকদিন প্রায় নিষিদ্ধের মতো ছিলো দলটির অবস্থা। সভা সমাবেশের অনুমতি পেতে শুরু করেছে নির্বাচনের আগে থেকে। এখন আমার মনে হয়, ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো ইস্যুগুলোতে তাদের নেতাকর্মীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় হয়ে জনমত গঠনের কৌশল নিতে পারে।”
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ