ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দেবর-ভাবির বিচ্ছেদ

প্রকাশনার সময়: ১০ মার্চ ২০২৪, ০৭:১৮

জাতীয় পার্টির (জাপা) বিভেদের মধ্যেই এক পক্ষের জাতীয় কাউন্সিল করে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি (আংশিক) গঠন করেছে রওশন এরশাদ। এতে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করার ঘোষণা দেয়া হয়। এ কাউন্সিরের মাধ্যমে দেবর-ভাবি পুরোপুরি আলাদা হলেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থিদের এ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে দৃশ্যমান হলো দেবর-ভাবির বিচ্ছেদ।

এদিকে জি এম কাদের অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আরেকটি ব্রাকেটবন্দি দল হতে পারে, কিন্তু আমরাই মূল জাতীয় পার্টি। গতকাল শনিবার রওশন এরশাদপন্থিদের কাউন্সিল প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রওশন এরশাদপন্থিদের পৃথক কাউন্সিল করা দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী। তবে আমরা তাদের কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে এবং থাকবে।

জানা গেছে, আগামী তিন বছরের জন্য রওশনপন্থিদের নিয়ে গঠিত এ কমিটিতে আরও রয়েছেন— নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, কো-চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, রাহগীর আল সাদ মাহি এরশাদ, গোলাম সরোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়।

সম্মেলনে রওশন এরশাদ বলেন, আজ আমার রাজনৈতিক জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। আমার গড়া প্রাণপ্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টি এ রকম একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছে দেখে আনন্দে আমার হূদয় কানায় কানায় ভরে গেছে। আজ যদি এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হতো তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে।

তিনি বলেন, পল্লীবন্ধু এরশাদ এদেশে যে নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতির প্রবর্তন করেছিলেন সেই রাজনীতি হারিয়ে যেতে বসেছিল। আজ এ দশম সম্মেলনের মাধ্যমে পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনে আবার আমরা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি এ সম্মেলনের মাধ্যমে।

আমরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখনো টিকে আছি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর যখন একটু ঘুরে দাঁড়ালাম তখন আমাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। মাননীয় আদালতের সুবিচারে পল্লীবন্ধু এরশাদ এবং আমি রওশন এরশাদ লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেই লাঙ্গল প্রতীক এখনো আমাদের জাতীয় পার্টির অনুকূলে আছে এবং আগামীতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।

কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই— পল্লীবন্ধু এরশাদের জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। আমরা এক আছি—ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকব। অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছে তারা কেউ পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি আদর্শ নিয়ে যায়নি। এমনকি তারা পল্লীবন্ধুর ছবিও সঙ্গে নেয়নি।

তাই জাতীয় পার্টি কখনো ভেঙেছে তা আমি মনে করি না। রওশন বলেন, আজ আমি এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে একদা যে সব নেতাকর্মী পল্লীবন্ধু এরশাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাদের সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই, আসুন আমরা সবাই জাতীয় পার্টির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই। দেশের রাজনীতিতে একটা সুষ্ঠুধারা বজায় রাখার জন্য জাতীয় পার্টির আর কোনো বিকল্প নেই। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির যাত্রা শুরু হয়।

এরপর নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়েছে দলটি। তারপর থেকে এরশাদ-রওশন ও জি এম কাদের বলয়কেই জাপার মূল ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাশাসক এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই নেতৃত্ব নিয়ে রওশন, কাদের অর্থাৎ দেবর-ভাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির মধ্যে কোন্দলের মাত্রা চরমে ওঠে। এত করে দেবর ভাবির মধ্যে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জি এম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। এছাড়া তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি।

নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থীরা সরাসরি পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে সভা ডেকে ফল বিপর্যয়ের জন্য দোষারোপ করেন। তাদের পদত্যাগও চান পরাজিত প্রার্থীদের অনেকেই।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী হিসেবে বেশ প্রভাবের সঙ্গে কয়েক যুগ ধরে রাজনীতি করেছেন রওশন এরশাদ। ছয়বারের সংসদ সদস্য। দুই মেয়াদে ছিলেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। টানা ৩২ বছর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মেলেটি দলীয় মনোনয়ন। ফলে ছিটতে পড়েছেন সংসদ থেকেও।

নির্বাচনের পর জাপা চেয়ারম্যানকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে অনুমোদন দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সরকারের আনুকূল্য পেয়ে দলে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন—এমন একটা প্রত্যাশা ছিল রওশন এরশাদ ও তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২৬ আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত ১১টি আসনে জয় পেয়েছে দলটি। ২৬ আসন লাঙ্গলকে ছাড় দিলেও তার অর্ধেকের বেশি আসন তারা খুইয়ে বসে। সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে দলটির প্রার্থী জিততে পারেননি। নির্বাচনের পর পরাজিত পার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। এর পর দলটিতে রওশন এরশাদের অনুসারী বলে পরিচিত প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ একে একে নেতাদের বহিষ্কার করেন জি এম কাদের।

এর পর গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাপার স্বঘোষিত চেয়ারম্যান হন রওশন এরশাদ। এরমধ্যে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জি এম কাদেরকে এবং উপনেতা হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে স্বীকৃতি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ৯ মার্চ দলের জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা দেন রওশন।

সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাঙনের দিকে যাচ্ছে। যদিও ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে রংপুরসহ ১৭টি জেলা সম্মেলনে যোগ দেয়নি। অন্য জেলার নেতাকর্মীরাও কমবেশি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। তবে কেন্দ্রের বিরোধের কমবেশি প্রভাব পড়েছে সবখানেই।

এদিকে আগামী ১২ অক্টোবর জাতীয় পার্টির (কাদেরপন্থিদের) কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। গত বুধবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে দলের প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভা শেষে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আগামী এপ্রিল থেকেই কাউন্সিলের প্রাথমিক কাজ শুরু হবে।

জাতীয় পার্টিতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। দলীয় পদ নিয়ে উভয়ের দ্বন্দ্ব বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বহু আগেই রওশন ও কাদেরকে সামনে রেখে দলীয় নেতাদের ভিন্ন দুটো বলয় তৈরি হয়েছে।

এতদিন সৃষ্টি হওয়া নানা দ্বন্দ্ব মধ্যস্থতার ফলে মিটেও গেলেও এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাবি-দেবরের দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে রূপ নেয়। যা এরশাদের মৃত্যুর পর এবারের দ্বন্দ্ব জটিল অবস্থা ধারণ করে। বার বার তাদের দ্বন্দ্ব মিটে গেলেও এবার কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন রওশন এরশাদ।

রওশনপন্থি জাতীয় পার্টির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় পুরো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ মৎস্যভবন এবং শাহবাগ এলাকা। রঙ-বেরঙের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে যায় সম্মেলনস্থল।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ