নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বারবার রাজপথে সরব থেকেছে বিএনপি। কিন্তু জনস্বার্থ কর্মসূচিতে বরাবরই পিছিয়ে রয়েছে দলটি। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া বন্দি হওয়ার পর থেকে সব কর্মসূচিতে তার মুক্তির দাবিই থাকছে প্রধান এজেন্ডা। সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়ার পরও বিএনপির দাবি দলীয় প্রধান কার্যত ‘গৃহবন্দিই’। তাই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতেই নানা কর্মসূচি পালন করছে দলটি।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। নির্বাচনের পর লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এদিকে ভর্তুকি সমন্বয়ের কারণ দেখিয়ে এক বছরের মাথায় গ্রাহক পর্যায়ে ফের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও এর প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি। যদিও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এবি পার্টি, এলডিপি কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়া জামায়াত ও বাম জোটসহ বিভিন্ন দল কর্মসূচি দিয়ে সরব রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য ছাড়া রাজপথে কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি। যদিও নেতারা বলছে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে যে কোনো সময় ঘোষণা করা হবে।
ভর্তুকি সমন্বয়ের কারণ দেখিয়ে এক বছরের মাথায় গ্রাহক পর্যায়ে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নতুন দর কার্যকর হবে। অর্থাৎ মার্চ মাসে যে বিল পরিশোধ করতে হবে, তা নতুন দামে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন দর অনুসারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে বাড়ছে ৭০ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। সরকারের নির্বাহী আদেশে এ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বিএনপির। এখন নরমাল কর্মসূচি দিয়ে দলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়। আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করে মিছিল সমাবেশের ধারায় ফিরে দলকে সংগঠিত করতে চায়। দলের তৃণমূলের কর্মীরা যাতে প্রকাশ্যে সভা সমাবেশে যোগ দিতে পারে সে দিকেই এখন তাদের নজর। এছাড়া আসন্ন রমজান মাসে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে দলটি।
যদিও অনেকে মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি বিগত আন্দোলনে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিয়ে জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে। এমন কোনো কর্মসূচি দাঁড় করাতে পারেনি যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবে। তারা দীর্ঘদিন ধরে দলীয় স্বার্থ, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মামলা প্রত্যাহারের আন্দোলনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। যে কারণে তাদের আন্দোলন কর্মসূচিতে আশানুরূপভাবে জনসম্পৃক্ততা বাড়েনি। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে রাজপথে কর্মসূচি পালন করার বিষয়ে আলোচনা করছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কী ধরনের কর্মসূচি করা যায়— তা নিয়ে দলটির মধ্যে আলোচনা চলছে। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার রাতে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে এই নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ইস্যুতে বিএনপির সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের পক্ষ থেকে মানববন্ধন বা বিক্ষোভ সমাবেশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কর্মসূচি আসন্ন রমজান মাসজুড়ে করার প্রস্তাব করেছেন তারা। এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আরও আলোচনা হবে। এরপর নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা শেষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বিএনপি নেতারা বলেন, নির্বাচনের পর দলের অনেক নেতাকর্মীদের জামিন হলেও এখন অনেক নেতাকর্মী কারাগারে বন্দি আছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের জামিনে মুক্ত করার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার এ মনোভাবকে সমর্থন জানিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকরা নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে বৈঠকে বেশ কিছু কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয়েছে। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আসন্ন রমজানে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন নেতারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এছাড়া রমজানের পর ধীরে ধীরে মাঠের কর্মসূচিতে মনোযোগ দেবে বিএনপি। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মানববন্ধন বা বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, বিএনপি তো স্বাভাবিক কোনো কার্যক্রমই করতে পারছে না। তারা লিফলেটও বিতরণ করতে পারছে না; সেখানেও তাদের ধাওয়া করা হচ্ছে। তাদের হাজার হাজার নেতা জেলের মধ্যে আটক রয়েছে। সারা দেশে তাদের নেতাকর্মীরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। তাদের কোনো কর্মসূচি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি যেসব কর্মসূচি পালন করছে তার অনেক কিছুই জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি এটাও জনগণের জন্য এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে কর্মসূচি এটাও জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে আসন্ন রমজান মাসজুড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি ও সাংগঠনিক শক্তি যাচাই করতে চায় বিএনপি। কৌশল হিসেবে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ইফতার মাহফিল আয়োজন করার প্রস্তাব করেছে বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তারা এ-ও প্রস্তাব করেন, কেন্দ্রীয় ইফতারের পাশাপাশি সাংগঠনিক জেলা, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডেও ইফতারের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এসব ইফতারে কারাবন্দি পরিবার, কারামুক্ত নেতাকর্মী, গুম-খুনের শিকার যেসব পরিবার, তাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানোর নির্দেশনা দেয়া হবে। ইতোমধ্যে আসন্ন রমজানে দুটি ইফতারের শিডিউল চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। রমজানের প্রথম দিনে এতিম ও আলেমদের সঙ্গে এবং ২৮ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করবেন বিএনপি নেতারা। গত শনিবার বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান। এছাড়া স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রমজান মাসকেন্দ্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে লিখিত আকারে জানানো হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপির কমর্সসূচি আসবে। দলের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে সিদ্ধান্ত হলেই আমরা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেব।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি চলমান আন্দোলনে রাজপথেই রয়েছে। এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে কর্মসূচি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। রমজান মাসে ইফতার মাহফিলের পাশাপাশি জনস্বার্থ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে বিএনপি।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, বিএনপি সব সময় জনগণের স্বার্থে মাঠে ছিলো, সামনেও থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ নিয়ে কর্মসূচি দেয়া হবে। গতবার রমজানের মধ্যেও আমরা কর্মসূচি পালন করেছি, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। গতবার কর্মসূচি পালন করে গিয়ে আমরা ইফতার করেছি। যদিও এবার পরিবেশটা অন্য রকম, এখনো আমাদের অনেক নেতা আটক রয়েছে। কিছু নেতাদের জামিন হয়েও অনেকেরে জামিন দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এখনো অধিকাংশ নেতাকর্মী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। তারপরও আমাদের আন্দোলন চলবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে আমদের কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ ইস্যুতে যুগপৎভাবে কর্মসূচি দেয়া যায় কিনা এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ