দেড় বছর ধরে সরকার পতনের আন্দোলন করেও ‘চূড়ান্ত’ পর্যায়ে এসে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। নির্বাচনের আগে টানা হরতাল-অবরোধ দিয়েও আন্দোলনে উত্তাপ ছড়াতে পারেনি দলটি। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ কারাগারে, বাকিরা আত্মগোপনে। যার রেশ নির্বাচনের পরও দৃশ্যমান। আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে দলের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আন্দোলনে বিদেশনির্ভরতার কথাও বলেছেন অনেকে। আন্দোলনে ব্যর্থতার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে তৃণমূলকে। নির্বাচনের পরও মামলা এবং গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকায় ফিরছেন না অনেকেই।
২০২২ সালের আগস্ট থেকে সরকারবিরোধী টানা আন্দোলন করেছে বিএনপি। শুরুতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, বিভাগীয় সমাবেশ এরপর রোডমার্চ কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের দুই মাসে কখনো হরতাল, কখনো অবরোধ। এরপর আন্দোলনের ‘চূড়ান্ত’ ধাপে এসে অসহযোগ কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর ‘চূড়ান্ত’ ধাপের আন্দোলনে আর উত্তাপ ছড়াতে পারেনি দলটি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় রাজপথে দেখা মেলেনি শীর্ষনেতাদের। আত্মগোপনে থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এছাড়া পিকেটিং ও ঝটিকা মিছিলে তাকে ছাড়া অন্য নেতাদের তেমন দেখা যায়নি।
বিএনপির দেশব্যাপী সমর্থন ও শক্তি থাকার পরও আন্দোলন কেন বিফল হলো-এ প্রশ্ন এখন দলটির নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। সরকার পতনের আন্দোলনের শেষের দিকে মামলা, হামলা ও নির্যাতনে বাড়িঘর ছাড়া বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী। কারাবন্দি ২৫ হাজারেরও বেশি ছাড়িয়েছে। সাজা হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমান উল্লাহ আমানসহ বিভিন্ন স্তরের নেতার। এমন পরিস্থিতিতে ‘চূড়ান্ত’ ধাপের আন্দোলনে উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। নির্বাচনের আগে ঢিলেঢালা কর্মসূচিতে দাবি আদায় হয়নি, সরকারেরও পতন ঘটেনি। এমনকি নির্বাচনও হয়েছে, নতুন সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। এতে করে হতাশা ভর করছে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। অনেক এলাকায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি বিএনপির নেতাকর্মীরা।
বিএনপি সূত্র জানায়, ২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এর পর আন্দোলনে বারবার হোঁচট খেতে হয় তাদের। প্রথমে ২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে হোঁচট খায়; এই সংকট কাটিয়ে উঠতে ছয় মাস সময় লাগে বিএনপির। এর পর গত ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির হোঁচট খায়; এই ব্যর্থতার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নতুন করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যন্ত তিন মাস ধরে দফায় দফায় নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে নিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু সংঘাত ও সহিংসতায় পড়ে সেই মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে পণ্ড হয়ে যায়। মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নানা সমালোচনা হয়। সমমনা দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ, মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড করা বা এ নিয়ে সরকারের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু মহাসমাবেশের নিরাপত্তার জন্য কোনো জায়গায় দলের পক্ষ থেকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়নি। পরে এ নিয়ে বিএনপির ভিতরে প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন তোলে জোটের শরিকরাও।
অভিযোগ রয়েছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আয়োজন করা হলেও তা সফল করতে কোনো পরিকল্পনা নেননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এছাড়া সরকার কী কৌশল নিচ্ছে সেটাও জানার চেষ্টা করেননি বিএনপি নেতারা। এক সপ্তাহ আগেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট করে বলেছিলেন- হেফাজতের যে পরিণতি হয়েছিল সেটার জন্য বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে। সারা দেশ থেকে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মীর শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দল থেকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়নি। সমাবেশের পরিধি যখন ধারণাতীত এলাকা ছাড়িয়ে যায় তখন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেনি দলটি।
জানা গেছে, ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে বিলোপের পর তা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নামে বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৪ সালে ভোট ঠেকানোর ঘোষণাও দিয়েছিল বিএনপি, তবে সফল হয়নি। এরপর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে। দলটির সাতজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ২২ সালের ডিসেম্বরে একযোগে সবাই পদত্যাগ করেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, অতীতের আন্দোলনে ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি না হয় সেটাই সব সময় চেয়েছিলেন দলটির কর্মীরা। রাজধানীকে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে, আর চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকা ঘিরেই নেয়া হয় দলটির সব কর্মসূচি। ২৮ আক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত মুভমেন্টে যেতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু দলের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই ব্যর্থ হয় বিএনপি। বিএনপির পরিকল্পনা এবং তথ্য আগেই ফাঁস হয়ে যায়, বিএনপির সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার ও প্রশাসন পদক্ষেপ নেয়। একাধিক পরিকল্পনা না নেয়ার ফলে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী মামলা, হামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে এখন বাড়ি ফিরতে পারছেন না তাদের জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, সব কিছু যেহেতু লিগেলের ব্যাপার, তাই আমারা লিগেলভাবেও চেষ্টা করছি এবং এর বাইরেও চেষ্টা করছি।
বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতারা জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি, কিন্তু বারবার আন্দোলনে ব্যর্থ হচ্ছে দলটি। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের ব্যর্থতার কারণেই বারবার এমন হচ্ছে। কিন্তু এতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিএনপি এত বড় একটি দল তাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া হয় তা ফাঁস হয় কী করে? আর একাধিক পরিকল্পনা না নেয়ার কারণে বারবার ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে। তারা আরও বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত সব কর্মসূচি সফল করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যেও নেতাকর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে থাকে। জেলাগুলোতে যেভাবে আন্দোলন হয় সেভাবে ঢাকাতে আন্দোলন হচ্ছে না। আমাদের কষ্ট হচ্ছে ঢাকায় আন্দোলন হয় না। ঢাকায় জোরালো আন্দোলন হলে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পূর্ণ করতে পারত না। ঢাকায় আন্দোলন জোরদার করার জন্য আমারা কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছি।
বিএনপির সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর হামলা, মামলা গ্রেপ্তারের কারণে সিনিয়র নেতারা অনেকেই এখনো আত্মগোপনে। বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁজালো বক্তব্য দেয়া ঢাকা মহানগরের নেতারাই প্রকাশ্যে আসছেন না। এমন অবস্থায় অঙ্গ সংগঠনগুলোতে টাকার বিনিময়ে কমিটি দেয়ায় কর্মসূচি ‘ফ্লপ’ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া বিপর্যস্ত নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করার মতো কোনো কার্যক্রমও শুরু করেনি দলটি। নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। সারা দেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা হাজার হাজার মামলা পরিচালনার জন্য ১০টি বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হলেও তাদের কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান হয়নি। অনেক জেলার নেতাকর্মীদের কারাগার থেকে মুক্ত করতে নেই কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা। কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের পরিবারের মানবেতর জীবন ও অসহায়ত্বের কারণেও অনেক কর্মী রাজনীতির ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে তারা এখন ভীতসন্ত্রস্ত।
নোয়াখালী জেলা যুবদলের এক নেতা বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীরা যেমন আমাদের ওপর হতাশ, তেমনিভাবে আমরাও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হতাশ। ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতন-নিপীড়ন ও মামলা-হামলায় অতিষ্ঠ নেতাকর্মীরা। এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জন্য অনেক নেতাকর্মী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা এখন দিকশূন্য, জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, শুধু আপনি ভালো থাকলে তো হবে না, পরিবারের লোকজনও তো ভালো থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট-সুপরিকল্পিত কোনো কিছু হচ্ছে না।
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রহিম নেওয়াজ বলেন, নির্বাচনের পরও আমাদের নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কারণ ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা বিএনপি নেতাকর্মীদের যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মারধর করছে। যার কারণে বিএনপি নেতাকর্মীরা বাড়ির বাইরে খুব কমই বের হচ্ছে। এ সরকার অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্যই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। দেশের মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়নি। এতেই বোঝা যায় এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। ’৭১ সালের যুদ্ধের সময় যেমন রাজাকাররা পাকবাহিনীদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর দেখিয়ে দিয়েছে; তেমনিভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা পুলিশকে দেখিয়ে দিয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ