বিএনপির সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ। এরপর টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে দলটি। কিন্তু নির্বাচনের পরে নতুন করে আর বড় কোনো আন্দোলন কর্মসূচি নেই বিএনপির। লিফলেট বিতরণ ও দোয়া কামনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে দলটি।
এমন পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা আন্দোলনের কর্মকৌশল নিয়ে ভাবছেন। একই সঙ্গে তারা রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গেও কথা বলছেন। তারা আপাতত আগামী তিন মাসে ধীরে চলো নীতির পক্ষে মতামত তুলে ধরেছেন। তাই কঠোর কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আপাতত ‘পরিস্থিতি’ বুঝে সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।
জানা গেছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে সক্রিয় ছিল বিএনপি। বিভাগীয় সমাবেশ, পদযাত্রা, গণমিছিল, হরতাল, অবরোধের পর অসহযোগের ডাক দিয়েও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ে সফল হয়নি তারা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এখন নতুন কর্মপরিকল্পনা ঠিক করছে জোটের হাইকমান্ড।
বিএনপি এখন সহিংসতার তকমা এড়িয়ে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মাধ্যমেই সরকারকে চাপে রাখতে চায়। সূত্রমতে, ৭ জানুয়ারি ‘ভোট বর্জন করায়’ বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো এলাকায় সাধারণ মানুষকে লিফলেটসহ ফুল দিয়ে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। এরপর ৩০ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন শুরুর দিনে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু রাজধানীতে অনুমতি না থাকায় পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। এরপর দুই সপ্তাহ বিরতি দিয়ে গত রোববার ছয়দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় দলটির পক্ষ থেকে। তবে, এসব কর্মসূচি সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে দাবি করলেও তা গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
ঘোষিত এসব কর্মসূচির বাইরে কঠোর কর্মসূচি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন, সরকারবিরোধী কঠোর কর্মসূচি বলতে নির্বাচনের আগে দেয়া হরতাল-অবরোধ বা বড় কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি। এর কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। এরপর রমজান শুরু। আর রোজার ঈদের পরই এইচএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার কিছুদিন পর আবার ঈদুল আজহা। তাই ইচ্ছা থাকলেও কোরবানি ঈদের আগে সরকারবিরোধী কঠোর কর্মসূচি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মূলত, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই তিন মাসে দৃশ্যমান বড় কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না দলটি। এই সময়টাতে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের অভাব, নাগরিক হয়রানির ঘটনাসহ জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিয়ে মাঠে থাকবে। এ সময়ে নতুন কোনো ঘটনা সামনে এলে তা নিয়ে তাৎক্ষণিক কর্মসূচি দেবে।
ফাঁকে ফাঁকে ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি থাকতে পারে। তবে সেগুলো বড় ধরনের কিছু নয়। এদিকে বিএনপির সপ্তাহব্যাপী ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গত মঙ্গলবার ও বুধবার (১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি) দেশের সব মহানগরে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছে তারা। এছাড়া গতকাল শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার প্রতিবাদ ও তাদের স্মরণে সব মসজিদে দোয়া মাহফিল কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এছাড়া আজ শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সব জেলা সদরে লিফলেট বিতরণ এবং ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সব উপজেলা এবং ইউনিয়নে লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করা হবে।
এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দ্রব্যমূলের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ও মানুষের জীবন-যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যখাতের রুগ্ন দশা, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা ও অপশাসনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে। এছাড়া সীমান্তে বিজিবি সদস্যসহ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা, মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় সরকারের নতজানু নীতির বিষয়টিও প্রচার করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সাধারণ মানুষের হাতে লিফলেট তুলে দেবেন দলের নেতারা।
পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি ধৈর্যসহকারে সতর্কতার সঙ্গে সামনে এগোনোয় কৌশলী হচ্ছে। একতরফা নির্বাচনের পর ঝিমিয়ে পড়া তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে নিয়মিত কর্মসূচি দেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
বৃহস্পতিবার কারাগার থেকে বেরিয়েই ‘ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার’ আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বললেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, নেতাকর্মীদের হতাশার কিছু নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার সাড়ে তিন মাস পর জামিনে গতকাল বৃহস্পতিবার মুক্তি পান মির্জা ফখরুল ইসলাম। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তি পান তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, ৭ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচন করে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, যে কৌশলই আমরা নিচ্ছি সেখানে বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন থাকবে। মানুষ হয়তো প্রত্যাশা করেছিল এই সরকার বিদায় নেবে। কিন্তু বিদায় তো নেয়নি। কিন্তু এটাও ঠিক একটা স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় দেয়া এটা তো সহজ কোনো সংগ্রাম নয়। এটা কঠিন এবং অনেক সময় দীর্ঘ সময় লাগে। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলনের একটা পর্যায় ছিল। এখন আমরা একটা নতুন পর্যায়ে যাব। আমরা সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা-বিশ্লেষণ করছি। অবাস্তব বা কল্পিত চিন্তার মাধ্যমে আন্দোলনকে পরিচালিত না করে, এখনকার বাস্তবতাকে নিয়েই আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা হবে।
দলটির কয়েক নেতা বলেছেন, কঠোর কর্মসূচি দিলে নতুন করে গ্রেপ্তার শুরু হতে পারে। কেননা, গত বছরের শুরুতে দল বড় শো-ডাউনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের বার্তা দিয়েছিল। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও আশা সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও এর পরের পরিস্থিতি সব কিছু পাল্টে দেয়। ওই সমাবেশে পুলিশকে পিটিয়ে মারার অভিযোগে দলটির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন।
দলীয় কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে নেতাকর্মীরা মামলা-গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িছাড়া হয়ে পড়েন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ বিএনপি যে ভোট বর্জনের আহ্বান করেছে তাতে মানুষ সাড়া দিয়েছে।
দেশের জনগণের প্রতি আওয়ামী লীগের কোনো আস্থা নেই, এ জন্যই ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে সব সময় ভয় এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে, কখন যে জনগণ ক্ষমতা নিয়ে নেয়। জনগণ যখন রাস্তায় নামবে তখন কোনো কিছুতেই কাজ হবে না। আওয়ামী লীগের উচিত দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যদি ক্ষমতা বদল না হয়, তখন ভিন্ন কিছু হতে পারে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, আন্দোলনের বিকল্প কোনো পথ নেই। দেশে ফ্যাসিবাদী তন্ত্র কায়েম হয়েছে। জনগণ নিয়ে আমরা যেই আন্দোলন করেছি তাতে আমরা সফল হয়েছি। এক তন্ত্রের কাছে তো আমরা মাথানত করতে পারি না। সরকারের অত্যাচারে এখনো তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী তাদের বাড়িতে যেতে পারছে না।
বিএনপি কৌশল হিসেবে ধীরগতির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, সময় হলে সমাবেশ, বিক্ষোভ, হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দেখতে পাবেন। এখানে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, হতাশ হয়েছে সরকার। এ জন্যই এমপি-মন্ত্রীরা হতাশার বক্তব্য দিচ্ছে। সরকার একতরফাভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসেছে এর বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলবে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ