২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। লক্ষ্য ছিল চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটানো। তবে এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
এতে করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনেকটা হতাশায় ভুগছে সরকারবিরোধীরা। নির্বাচনের আগে টানা কর্মসূচি পালন করলেও এখন রাজপথে দেখা নেই তাদের। আপাতত নতুন কোনো কর্মসূচি ঘোষণার কথাও ভাবছে না। ৭ জানুয়ারির পূর্বে আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
জানা গেছে, আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে না পারাকেও ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেন এ ব্যর্থতা, আন্দোলনের কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল— সেটা নিয়ে মূল্যায়ন করা শুরু করেছে বিএনপি। জোটের শরিকদেরও তা মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে শরিকদের মূল্যায়নগুলো পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি।
গণতন্ত্র মঞ্চ: বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম জোট ছিল সাতদলীয় জোটের গণতন্ত্র মঞ্চ। জোটভুক্ত দলগুলো হলো— জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে তারা সরব থাকলেও সারা দেশে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করলেও দলগুলোর কর্মীদের থেকে নেতাই বেশি দেখা গেছে। ২৫ থেকে ৩০ জনের মতো জনবল নিয়ে অধিকাংশ সময় কর্মসূচিতে পালন করেছে এ জোট।
১২-দলীয় জোট: ২০ দল ভাঙার পর ১২টি দল নিয়ে একটি জোট গঠন করা হয়। ১২-দলীয় এ জোটে রয়েছে— মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কেএম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এলডিপি, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি। ১২টি দল নিয়ে এ জোট গঠন করলেও কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে তেমন জনবল দেখাতে পারেনি। তবে নির্বাচনের আগে এ জোট থেকে কয়েটটি দল বেরিয়ে যায়।
১১-দলীয় জোট: বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১১-দলীয় সমমনা জোটোর অধীকাংশ কর্মসূচি রাজধানীর বিজয়নগরের আল রাজী কমপ্লেক্সের সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সংগঠনে ১১ রাজনৈতিক দল থাকলেও তারা রাজপথে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাদের কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ নেতাকর্মীকে অংশ নিতে দেখা যায়। তারা পুলিশের সামনেই সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করলেও তেমন বাধার সম্মুখীন হয়নি।
এদিকে গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি মিলে যৌথভাবে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। এ দল দুটিতেও লোকবল দেখা যায়নি।
কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি: বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে যেই জোটগুলো; এ জোটের কর্মীদের থেকে নেতাদের বেশি উপস্থিতি দেখা গেছে। একাধিক দল নিয়ে জোট গঠন করলেও সেই তুলনায় জনবল কর্মসূচিতে জনবল দেখাতে পারেনি তারা। ৩০ থেকে ৪০ জন কর্মী নিয়ে সামাবেশ বা কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এদিকে জোটের তুলনায় একক দলগুলো ভালো সফলতা দেখিয়েছে। একক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে— লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি। এ দলগুলো এককভাবে কর্মসূচি পালন করলেও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোটগুলোর চেয়ে ভালো বেশি জনবল নিয়ে রাজপথে থাকতে দেখা যায়।
সূত্রমতে, আপাতত বড় কোনো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি। সাম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে একমত হন নেতারা। সেখানে সমাবেশ, সাংগঠনিক সফরসহ আরও কিছু কর্মসূচি প্রস্তাব করা হলেও সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আপাতত লিফলেট বিতরণ করা হবে। এর মাধ্যমে নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যসহ নানা ইস্যুতে সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সারাংশ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় দলটি। সারা দেশের মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড সব পর্যায়ে এ কর্মসূচি পালন করবে। আজ অথবা আগামীকাল থেকে সারা দেশে দুই অথবা তিন দিনের এ কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে। যা ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে দলটির।
জানা গেছে, জনগণের ভোট বয়কটের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিমাদের অবস্থানই মূলত বিএনপিকে আশা জোগাচ্ছে। নেতারা বলছেন, মামলা-গ্রেপ্তারে বিপর্যস্ত বিএনপি কম সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াবে।
তবে নির্বাচন বয়কট করা বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের নেতারা বলছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোট বর্জন করে সরকার ও একতরফা নির্বাচনের প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা জানিয়েছে। এটাকে আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য তথা নৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছে তারা।
তবে একই সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে দাবি আদায় করতে না পারাকেও ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেন এ ব্যর্থতা, আন্দোলনের কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল— সেটা নিয়ে মূল্যায়ন করা শুরু করেছে বিএনপি। জোটের শরিকদেরও তা মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে। আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে শরিকদের মূল্যায়নগুলো পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিএনপি।
বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের যুগপৎ আন্দোলন এখনো চলমান রয়েছে। আন্দোলনের সফলতা ব্যর্থতা বলা যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৩ বছর আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা মনে করি আন্দোলন সফল হয়েছে। মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়নি, এতেই বোঝা যায় জনগণ আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলছি, সমমনা দলগুলোও একই কথা বলে যাচ্ছে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। একদিন এর পরিবর্তন হবেই। যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির বিষয় আলোচনা চলছে, দ্রুতই কর্মসূচি আসবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নয়া শতাব্দীকে বলেন, প্রাথমিকভাবে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে পেরেছি। মানুষ আমাদের আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। যদিও আমরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারিনি।
কিন্তু সাধারণ মানুষ নির্বাচন ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে বিরোধী দলের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে। এখন পরবর্তীতে আন্দোলন কর্মসূচি কীভাবে সফল করব সেটাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। ৭ জানুয়ারির পর নতুন করে কীভাবে আন্দোলন কর্মসূচি বেগবান করা যায় সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা জোনায়েদ সাকি নয়া শতাব্দীকে বলেন, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জনগণকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছি। আমরা আন্দোলনেই রয়েছি। সরকার নিজেদের মধ্যে একতরফা নির্বাচনের নামে ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে। এখন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করতে চাই। এখন ফের যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তৎপরতা চলছে। বিভিন্ন দল যার যার মতো করে কর্মসূচি চলিয়ে যাচ্ছে, এখন যুগপৎ ভাবে আন্দোলনের জন্য আলোচনা চলছে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি মানুষ যাতে ভোট কেন্দ্রে না যায়, ভোট প্রয়োগ না করে।
প্রাথমিকভাবে আমরা এতে সফল হয়েছি। যেভাবে ২৮ অক্টোবর দমনপীড়ন করা হয়েছে এতেই প্রামাণিত হয় জনগণের প্রতি এ সরকারের কোনো আস্থা নেই। আমাদের দাবি আদায়ে আন্দোলন চলছে যতদিন পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়নি, ডামি নির্বাচন হয়েছে। আমরা তো নির্বাচন বর্জনই করেছি, ১৪ দল ধ্বংস হয়েছে, জাতীয় পার্টি ধ্বংস হয়েছে। জাতীয় পার্টির অধিকাংশ প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছে। আমরা সরকার বিরোধী আন্দোলনে রয়েছি, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ