জাতীয় পার্টির (জাপা) রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা রাজধানীর কাকরাইলের কার্যালয় দখলে নিয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের জন্য জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘দখলে’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে রওশন এরশাদপন্থিরা। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলের কার্যালয়ে যান তারা। দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। সকাল ১০টার দিকে তারা কার্যালয় ছেড়ে যান। রওশনপন্থিরা বের হয়ে যাওয়ার পর দুপুরে দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ফের নিজেদের ‘দখলে’ নেন জি এম কাদেরপন্থিরা।
এদিন সকাল ৮টায় কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে থাকা দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা। এর মাধ্যমে তারা ওই কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেন। ফুল দেয়া এবং মোনাজাত শেষে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কার্যালয় পরিদর্শন এবং সেখানকার স্টাফদের খোঁজখবর নেন রওশনপন্থি অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ।
এরপর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘অব্যাহতি পাওয়া চুন্নুর (মুজিবুল হক চুন্নু) চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করেই শত শত নেতাকর্মী সঙ্গে নিয়ে আমরা কার্যালয়ে প্রবেশ করেছি। দেখি কে প্রতিহত করে? কার কত বুকের পাটা আছে, তা আগামীতেই প্রমাণ হবে।’ দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় সেখানে অবস্থান শেষে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ত্যাগ করেন কাজী মামুনুর রশীদ ও রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা।
দুপুর দুইটার দিকে জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, এরশাদের প্রতিকৃতিতে নেই রওশনপন্থিদের দেয়া ফুল। ভবনের সামনে ঝুলছে জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর পক্ষ থেকে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানো বিশাল ব্যানার। তবে এসময় কার্যালয়ের সামনে দলটির কোনো পক্ষের নেতাকর্মীই চোখে পড়েনি। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে ভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলানো ছিল। কারা তালা ঝুলিয়েছেন, ফুল কারা সরিয়েছেন— এসব বিষয়ে বারবার জানতে চাইলেও কার্যালয়ে দায়িত্বে থাকা দুই নিরাপত্তাকর্মী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এসব বিষয়ে জি এম কাদেরপন্থি নেতা ও জাপার যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম বলেন, ‘দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া কয়েকজন এবং কিছু ভাড়াটে লোক সকালে এসেছিলেন। শুক্রবার বন্ধের দিন সকাল ৮টার দিকে তারা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দেন। এরপর তারা কার্যালয়ের নিচ তলায় অবস্থিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কক্ষে ১০ থেকে ১২ মিনিট অবস্থান করেন। পরে কার্যালয়ের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে কিছু সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যে, জাতীয় পার্টি অফিস কে বা কারা দখলে নিয়েছে। এ সংবাদ অসত্য। জাতীয় পার্টি সারা দেশে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে এক ও ঐক্যবদ্ধ।’ বেদখল বা পুনর্দখলের প্রশ্ন আসছে না।
জাপার নেতৃত্ব নিয়ে জি এম কাদের এবং রওশন এরশাদের পুরোনো বিরোধ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে চরমে পৌঁছেছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকতে না পেরে নির্বাচনে অংশ নেননি রওশন। তার অনুসারীদের মনোনয়ন দেননি জি এম কাদের।
গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জাপার ভরাডুবির পর সক্রিয় হয়েছেন রওশন। নির্বাচনে জি এম কাদেরের ভূমিকার সমালোচনা করে পদ হারানো নেতারা তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। গত ২৮ জানুয়ারি সভা ডেকে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন রওশন। জি এম কাদের এবং জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যহতির ঘোষণা দেন।
সকালে কার্যালয়ে প্রবেশ করে রওশনপন্থি অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আজ থেকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলাম। আমরা দলকে এগিয়ে নিতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করছি। পার্টিতে এখন আর জি এম কাদের ও চুন্নুর প্রয়োজন নেই। নেতাকর্মীরা প্রতারক ও বাচালদের দেখতে চায় না। তারা দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। পার্টির ইমেজ নষ্ট করেছেন। আমরা পার্টিকে পুনরায় শক্তিশালী করছি। পার্টি চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ দলের দায়িত্ব নেয়ার পর দলে প্রাণ ফিরে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা জাতীয় পার্টিতে তাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। জি এম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নুর জন্য দলের আজ বেহাল অবস্থা। তাদের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীদের আর আস্থা নাই। প্রয়োজনে তাদের অন্য কোনো পদের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জাপার রওশনপন্থি অংশের মুখপাত্র ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় বলেন, আজ সকালে (গতকাল) প্রয়াত প্রেসিডেন্টের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর কিছু নেতাকর্মী ভেতরে ঢুকে বৈঠক করেছেন। কাল থেকে আমাদের ধারাবাহিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে, তার আগে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলাম। আগামীকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাতীয় সমাজের একটি অংশের সমাবেশ রয়েছে।
গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের কাদের অংশের প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, আমরা এখন কাকরাইল অফিসে রয়েছি, এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুপুরের পর থেকে অফিসে এসেছি এখানে কাউকে দেখিনি।
নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা পেলেও প্রার্থীদের দেননি জিএম কাদের এ অভিযোগ তুলে তার সমালোচনা করছেন ভোটে হেরে যাওয়া লাঙলের প্রার্থীরা। এ কারণে কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহহিয়া চৌধুরীকে অব্যহতি দেন জি এম কাদের। রওশন তাদেরকে পুনর্বহালের ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল সকালে কাকরাইল কার্যালয়ে যাওয়া নেতাদের মধ্যে ছিলেন সুনীল শুভরায় এবং শফিকুল ইসলাম সেন্টু। ছিলেন জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে পদত্যাগ করার ৬৭১ নেতাকর্মীর অনেকে।
এদিকে আগামী ২ মার্চ জাতীয় পার্টির কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা দিয়েছেন রওশন এরশাদ। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে না পারায় ইসির কাছে দু’মাস সময় চেয়ে নিয়েছিল জাপা। এরপর আবার চিঠি দিয়ে সময় বাড়িয়ে নেয়।
সামরিক শাসনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাসীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাঙন কবলিত। এরশাদের জীবদ্দশায় জাপা, জেপি, বিজেপি ও জাপা (জাফর) নামে চার টুকরো হয়ে যায়। এরমধ্যে জেপি রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে। বিজেপি এবং জাপা (জাফর) রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে। রওশনের প্রক্রিয়ায় জাপার আরেকটি গ্রুপের আত্মপ্রকাশ সময়ের বিষয় বলে মনে করছেন অনেকেই।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ