দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাধারণ ও উপ-নির্বাচন মিলে বেশকিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটের তফসিলও ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনেও অংশ নেবে না বিএনপি। এভাবে একের পর এক নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে ভোটারদের সঙ্গে বাড়বে দলটির দূরত্ব। এতে করে ভোটারদের সঙ্গে বিএনপির তৃণমূল নেতারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে দলের মধ্যেই।
২০২১ সালের মার্চের পর থেকে দলীয় প্রতীকে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে দলটি। কিন্তু আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনগুলো আর দলীয় প্রতীক থাকছে না। তাই এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিএনপির জন্য অনুকূল হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। দলের ভেতরে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মতও বাড়ছে।
জানা গেছে, আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আগের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। অপরদিকে এ নির্বাচনে অংশ নিতে দলের তৃণমূলসহ বিভিন্ন স্তর থেকেও পরামর্শ আসছে। এতে করে নির্বাচনে যেতে কেন্দ্রের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়েও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে একটি অংশ সোচ্চার রয়েছেন। তাদের অভিমত, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে যাওয়াই দলের জন্য ইতিবাচক হবে।
সরকার পতনের বিএনপি একদফা আন্দোলনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখনো একদফা আন্দোলনেই মনোযোগ রয়েছে দলটির। তবে প্রতীক ছাড়া দলের কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে নমনীয় নাকি কঠোর হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। বিএনপির সিনিয়র নেতারা উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের মনোভাব জানতে কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখবেন। ভোটে আগ্রহী নেতাদের প্রথমত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার জন্য তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন। এরপরও স্বতন্ত্রভাবে কেউ অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে দল নমনীয় হতেও পারে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিএনপির স্থানীয় নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। এর মাধ্যমে বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। সুতরাং নির্বাচনে যাওয়ার এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তারা বলছেন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়া নেতাকর্মী এলাকামুখী হতে পারবেন। তা ছাড়া এ নির্বাচনেও যদি সরকার কারচুপির আশ্রয় নেয়, সে ক্ষেত্রে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আরও একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন নেতা বলেন, বিএনপির তৃণমূল খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। এখন শুধু সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে তাদের মনোবল চাঙা করা যাবে না। কারচুপি হলেও নির্বাচন সব সময় উৎসবের আবহ তৈরি করে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। তা ছাড়া নির্বাচনবিমুখ দল রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। এবার উপজেলা নির্বাচনে না গেলে যে ভুল হবে তা কাটিয়ে ওঠা বিএনপির জন্য কঠিন হবে।
সূত্র জানায়, দলের অনুমতি অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে হাই-কমান্ডের রোষানলে পড়তে হবে। এমনকি কারণ দর্শানোর নোটিস ও বহিষ্কার হতে পারেন। এসব ঝুঁকি মাথায় রেখেই কৌশলে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির অনেক নেতা। এদের মধ্যে রয়েছেন— সাবেক চেয়ারম্যান, বিগত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে হরতাল অবরোধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন অনেকে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্ন মারফতে বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে ভোটে অংশ নেয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তাদের সম্মতি চাইছেন। তবে দলে কোণঠাসা হয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ নেতাদের কেউ কেউ প্রয়োজনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েই ভোটে লড়বেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি তাই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। যদি কেউ অংশ নেয় সেই বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে জনগণ অংশ নেবে না।
তিনি বলেন, এই সরকার একেবারে দলীয়করণ করার জন্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। দলীয় প্রতীকে দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তারা তখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যেহেতু মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছে না সে কারণে এখন দলীয় প্রতীক বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার যত কিছুই বলুক তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। এ জন্য সবাই যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাই এই কৌশল নিয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় এ সরকার দেউলিয়া হয়ে গেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে সিদ্ধান্ত তা হচ্ছে- শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাব না। কারণ, তার অধীনে কোনো নির্বাচন কখনো অবাধ সুষ্ঠু হয় না। এর আগে যারাই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে এবার উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তাদের বিষয়ে দলীয় অবস্থান কী হবে, সেটি ভবিষ্যতে ঠিক করা হবে বলে জানান তিনি।
২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন শুরু হয়। দলটি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এর মধ্যে ২০২২ সালে বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
আগামী ৯ মার্চ ভোটের তারিখ রেখে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। একই দিনে আরও ২৩১টি পৌরসভা, বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও জেলা পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। গত বুধবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম এই তফসিল ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ৯ মার্চ সাধারণ ও উপ-নির্বাচন মিলে স্থানীয় সরকারের ২৩৩টি ছোট-বড় নির্বাচন হবে।
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ