দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব কিছুটা কমে। এরপর জাতীয় নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে সরব ছিল দলটি। বিএনপি-জামায়াতের এমন আন্দোলনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিল ঘোষণা করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। কিন্তু এ কর্মসূচিতে কোনো সমর্থন দেয়নি জামায়াত। এতে করে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব ফের সামনে এলো।
সূত্রমতে, গতকাল শুক্রবার দেশের সব জেলা শহরে কালো পতাকা মিছিল করেছে বিএনপি। এছাড়া আজ শনিবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে কালো পতাকা মিছিল করবে তারা। বিএনপির এ কর্মসূচি ঘোষণার পর সমমনা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দল ও জোট একই কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু এ কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়নি জামায়াত। বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণার পর গত রোববার রাতে জরুরি বৈঠকে বসে জামায়াতে ইসলামী। সেখানে বিএনপির সঙ্গে চলমান আন্দোলনে না থেকে নিজেরাই আলাদা কর্মসূচি পালনের বিষয়ে মত দেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এ নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা হয়নি। বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণার পরপর জরুরি বৈঠকে বসে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বিএনপির কর্মসূচিতে জামায়াতের কোনো সমর্থন থাকবে না। তবে জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের মতো পৃথক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে পৃথকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ ও অবিলম্বে প্রহসনের ডামি নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আগামীকাল রোববার সারা দেশের মহানগরীতে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে গত বুধবার এ কর্মসূচির ডাক দেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের পর যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলেরা সঙ্গে আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে বিএনপি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মন রক্ষা করতে গিয়ে জামায়াতের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে পারে না বিএনপি। এসব নানা বিষয় নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে।
এদিকে নির্বাচনের একদিন পর নির্বাচন বাতিল করে অবিলম্বে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত। গত ৯ ও ১০ জানুয়ারি দেশব্যাপী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এর পর নির্বাচন ইস্যুতে কোন কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি জামায়াতকে।
বিএনপির দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী ছিল জামায়াতে ইসলামী। ২০-দলীয় জোট ভাঙার পর জামায়াত এককভাবে পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ইস্যুতে এ দুদলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। গত বছর সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল যখন যুগপৎ আন্দোলন করেছে, তখন জামায়াত নিজেদের মতো করে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যায়। এরপর ২৮ অক্টোবর পল্টনে মহাসমাবেশ করে বিএনপি; এদিকে একই দিনে মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াত ইসলামী। এদিন বিএনপির মহাসমাবেশে হামলার প্রতিবাদে পরের দিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে বিএনপি। ওইদিন জামায়াতও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে হরতালের ডাক দেয়। এরপর থেকে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে টানা কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াতও। জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও একটি রাজনৈতিক সদল হিসেবে নিজেদের মতো করে কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। আগ বাড়িয়ে কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তারা মনে করেন চলমান আন্দোলনে সফলতা আসলে বিএনপি হবে তার প্রধান সুবিধাভোগী। কিন্তু দেশের এবং জনগণের স্বার্থে পেছনে না তাকিয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে জামায়াত। গত পনেরো বছর ধরে বিএনপির বহু নেতাকর্মী হত্যা-গুম, হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু জামায়াতের নেতাকর্মীরাও কম নির্যাতিত নয়। হত্যা-গুম, হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার অনেক নেতাকর্মী। একদফা দাবিতে যে আন্দোলন চলছে; পেছনে না তাকিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।
জানা গেছে, সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলনরত নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৬৩টি বিরোধী দলকে নিয়ে বিএনপির বৃহত্তর জোট গঠনের পরিকল্পনা করেছিল বিএনপি। নির্বাচনের আগে ভোট বর্জনকারী সমমনা ডান-বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলোকে এক জায়গায় আনতে চেয়েছিল দলটি। কিন্তু এখনো তা হয়নি। বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। জোট গঠনে জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি নেই। কিন্তু এই দলটির সঙ্গে আন্দোলন করতে আপত্তি করছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাম দলগুলো। তারা জামায়াতের সঙ্গে এক জায়গায় আসতে রাজি হয়নি। যদিও বিএনপি-জামায়াত দুটি দলেরই আন্দোলনের লক্ষ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো। কিন্তু রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেয়া হয়। এ জোট ভেঙে নতুন একাধিক জোট হলেও সেসব জোটে নেই জামায়াত।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নেতারা জানান, জামায়াত ইসলামীর অতীতে আন্দোলন সংগ্রামের অনেক ইতিহাস রয়েছে। জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও আন্দোলন করেছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াতকে নিয়ে এক ব্যানারে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। যারা জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করার বিষয়ে প্রশ্ন করে তারা আসলে দেশের ভালো চায় না। যারা জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করার বিষয়ে সমস্যা মনে করে তাদের জনশক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তারা।
সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের (একাংশের) সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করলে আজ আমাদের সমস্যা কোথায়? জামায়াতের মতো শক্তিকে বাইরে রাখা যাবে না। যারা বিভাজনের কথা বলছেন, তারা প্রকারান্তরে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন।
গত ১০ জুন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয় সরকার। নানা কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে। জামায়াত প্রকাশ্যে সমাবেশ করার পর বিএনপির অনেক নেতাদের মধ্যে সন্দেহের দানা বাধতে থাকে। এতে করে দল দুটির মধ্যে টানাপড়েন প্রকাশ্যে চলে আসে।
তখন বিএনপির অনেক নেতা বলেন— ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতা হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাবে। বিএনপি নেতাদের জামায়াতবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্যে দল দুটির মধ্যে যখন টানাপড়েন চলছিল। এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে দলীয়ভাবে শোক প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব কিছুটা কমে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে এড়িয়ে জামায়াত নিজেদের মতো করে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যায়।
এর পর ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে জামায়াতও কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন ফের দল দুটির মধ্যে দূরত্ব বাড়ল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, নির্বাচনের পর ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে দুদিন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সামনে আরও কর্মসূচি আসবে।
আপাতত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি আসছে না। সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভের মতো কর্মসূচির আসতে পারে। বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করছে আমরা একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের মতো করে কর্মসূচি পালন করব। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য তো একই। বিএনপির সঙ্গে মিল না রেখে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করার বিষয় জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ২৮ জানুয়ারি জামায়াত যেই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এটা দলীয় কর্মসূচি।
৭ জানুয়ারি নির্বানের আগে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি হয়েছে। এটা কর্মসূচির একটা ধাপ ছিল। আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন আমরা একসঙ্গে কর্মসূচি পালন করব। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের প্রতিবাদ এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ২৮ আমরা দলীয় কর্মসূচি পালন করব।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ