ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদেশে নজর বিএনপির!

প্রকাশনার সময়: ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৮

সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ের ‘চূড়ান্ত’ পর্যায়ে এসে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণা করার পরে মাঠে নেই প্রথম সারির নেতারা। কিছু স্থানে ঝটিকা মিছিল করেই স্থান ত্যাগ করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির কিছু নেতার দাবি বিদেশিদের চাপ আরও কঠোর না হলে এ সরকারের ‘বিদায় ঘণ্টা’ বাজানো সম্ভব নয়।

কারণ চলমান আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে। হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার ও গুলির মুখে সাধারণ নেতাকর্মীরা দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। এ কারণে শক্তিধর পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে বিএনপি। সম্প্রতি বিএনপির কিছু নেতার সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখা কথাবার্তা এ ধরনের ইঙ্গিত বহন করে। সার্বিক এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধানের তাগিদ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, কোনো আন্দোলনই এ সরকারের ওপর প্রভাব পড়বে না। আমরা যদি দেশের চলমান সমস্যার সমাধান না করি। আবার একতরফা নির্বাচন হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। এ অবস্থা থেকে সরে আসার কোনো বিকল্প নেই।

বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সরকার পতনের একদফা ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলনে রয়েছে তারা। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে তারা। এমন অবস্থায় গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ছয় দফায় ১২ দিনের অবরোধ ও দুই দফায় তিন দিনের হরতাল শেষ করেছে দলটি। আরও একদিনের অবরোধ কাল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত চলবে। দলটির ঘোষণা অনুযায়ী চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচিতে রয়েছে তারা।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। সেই অবস্থান থেকে নড়তে নারাজ পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা বাধা প্রয়োগ করবে তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তারা। সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য এমনকি বিরোধী দলের কেউ যদি তাতে জড়িত থাকে সবার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পশ্চিমারা।

এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শর্তহীন সংলাপ চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ আহ্বান জানিয়ে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এতে সব পক্ষকেই পূর্বশর্ত ছাড়া সংলাপে বসার অনুরোধ জানান হয়েছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর দেয়া চিঠির জবাব দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দলটি। তবে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে সংলাপের পরিবেশ নেই বলে মন্তব্য করেছে দলটি। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি বলেন, চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানকে সাধুবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে- অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সংলাপে বিএনপির আপত্তি নেই। কিন্তু দলের মহাসচিবসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে সংলাপ করার মতো পরিবেশ আছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে দলটি। চিঠির বিষয়বস্তু বিষয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, আলোচনার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। সরকারকে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দেয়া চিঠির জবাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আরাফাত ডোনাল্ড লুর চিঠির উত্তর দেন। চিঠিতে বলা হয়, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। আওয়ামী লীগ কয়েক মাস ধরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিঃশর্ত সংলাপের জন্য দরজা খোলা রেখেছিল। বিএনপি এই জাতীয় সংলাপের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের ওপর অনড় থাকায় সংলাপ হয়নি।

তাতে আরও বলা হয়, বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতসহ তাদের মিত্ররা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অবরোধ করছে। এ ধরনের কর্মসূচি কার্যকর করতে অগ্নিসংযোগের মতো জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মতে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১৫৪টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে অবরোধ সমর্থকরা। চলমান অবরোধ এবং এ ধরনের কর্মসূচির প্রধান দাবির মধ্যেও বিএনপি ও অন্যদের সঙ্গে যদি আওয়ামী লীগ বসতে পারে, তবুও কোনো অর্থবহ সংলাপ হবে না।

আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনি কাজ চূড়ান্ত করতে সমস্ত সময় ব্যয় করতে হবে। ৩০০টি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পর্যালোচনা এবং চূড়ান্ত করা, তাদের ইশতেহার তৈরি করা, প্রচারণার কৌশল চূড়ান্ত করা, ভোটারদের কাছে প্রচারণা কাজ রয়েছে। যদি সব শর্ত একটি সংলাপের জন্য অনুকূল হয়, তবে বর্তমান বাস্তবতায় অর্থপূর্ণ সংলাপ করার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে নেই।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার ফের একদফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। এজন্যই বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। অপরদিকে প্রথম সারি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের প্রতিদিন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একের পর এক নেতাদের সাজা দেয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্ক মাঠ নিয়েই বিএনপি কৌশলে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে। নেতাকর্মীরা সবাই মাঠে নেমে আসছে ধীরে ধীরে। ঘরেও নিস্তার দিচ্ছে না পুলিশ। বেছে বেছে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মাঠে নামা- সবকিছুই কৌশলে করছেন তারা।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে নির্দেশ দিয়েছে বিএনপির হাই কমান্ড। এদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে গেছেন কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ ও মধ্যমসারির নেতারা। চলমান আন্দোলন এভাবে আরও অন্তত দুই সপ্তাহ চালিয়ে নিতে চায় বিএনপি।

এরপর ‘ডু অর ডাই’ মাঠে নামতে চায় বিএনপিসহ সরকার বিরোধীরা। এজন্য গ্রেপ্তার এড়াতে অন্তত দুই সপ্তাহ নিজের বাড়ি বা বাসার পরিবর্তে অন্যত্র অবস্থান করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর গ্রেপ্তার এড়াতে চলমান কর্মসূচিতে তেমন সরব উপস্থিতি দেখা যায় না তাদের। চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা আসলেই আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা একযোগে বেরিয়ে আসবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, আমরা সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রয়েছি। আমাদের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। প্রতিদিন কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গ্রেপ্তার এড়িয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে তারা। বিএনপি জনগণের দল, জনগণ নিয়েই বিএনপি রাজনীতি করে। এর আগে বিভাগীয় পর্যায়ে বিএনপি যেসব কর্মসূচি পালন করেছে সেখানে সাধারণ মানুষের ঢল নেমেছে।

বিএনপির সব কর্মসূচি জনগণই সফল করে। বিএনপি কখনো বিদেশিদের ওপর ধরনা দেয়নি এবং দেবেও না। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, বিএনপির আন্দোলন চলমান রয়েছে। এ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। চলমান আন্দোলন কর্মসূচি নেতাকর্মীরা তাদের সাধ্যমতো পালন করে যাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক চরমভাবে বিরাজ করছে।

তাই গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্যই দলের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেই স্থান ত্যাগ করছে। এখন হরতাল অবরোধ চলছে সামনে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মসূচির ধরন পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, বিএনপি কখনোই বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল নয়, দেশের জনগণের ওপর নির্ভরশীল। আমরা দেশের জনগণ নিয়ে রাজনীতি করি, বিএনপি জনগণের দল। জনগণের ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যই আমরা রাজপথে আন্দোলন করছি।

আর আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী আটক হচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘরে থাকতে পারছে না, একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তবুও আমাদের কর্মসূচি থেমে নেই।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ