দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। তবে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো ভোটে না আসার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও পুরোদমে ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে টানা তিনবারের সরকার গঠন করা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সেই লক্ষে গত শনিবার ১৮ নভেম্বর থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে দলটি। আর গতকাল মঙ্গলবার ছিল মনোনয়ন বিক্রির শেষ দিন। চার দিনে দলটির মনোনয়ন কিনেছেন ৩৩৬২ জন। ৩০০টি আসন ধরলে প্রতি আসনের বিপরীতে নৌকা পেতে লড়বেন গড়ে প্রায় ১১ প্রার্থী। যদিও শোনা যাচ্ছে— শরিকদের ৫০টি আসন ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে দলটি ২৫০টি আসনে একক প্রার্থী দিতে পারে। তাহলে আসনপ্রতি প্রার্থী দাঁড়াবে ১৩ জন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন কিনতে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, স্পোর্টসম্যান, অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাংবাদিক, সবেক সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে মনোনয়ন কেনার হিড়িক লক্ষ করা গেছে। এছাড়া অনেক তরুণ প্রার্থীও এবার দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী। তারাও দলবল নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে নির্ধারিত বুথ থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তবে শেষ দিনে মনোনয়ন ক্রয়ের চেয়ে জমা দিতেই বেশি দেখা গেছে।
চার দিনে সর্বমোট মনোনয় বিক্রি হয়েছে ৩,৩৬২টি। এর মধ্যে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ১২১টি মনোনয়ন। সবচেয়ে বেশি মনোনয় ফরম বিক্রি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে ৭৩০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। বিক্রির তালিকায় এরপরই শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম। এ বিভাগে আওয়ামী লীগের নৌকা চান ৬৫৯ জন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৪০৯টি, খুলনা বিভাগে ৪১৬টি, রংপুর বিভাগে ৩০২টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৯৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭২টি এবং বরিশাল বিভাগে ২৫৮টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে দলটি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমের দাম ৩০ হাজার টাকা থাকলেও এবার ২০ হাজার বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। সে হিসাবে এবার মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। তাই স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিক্রিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আমাদের প্রত্যাশার থেকেও অনেক বেশি মানুষ মনোনয় ফরম কিনছেন।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভা থেকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা দলটির সভাপতির ধানমন্ডি কার্যালয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে হতো।
তবে এবার নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রম করবেন না। তাই ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তেজগাঁও কার্যালয়ে দলটির মনোনয়ন বোর্ডের সভা হবে। সভার প্রথম দিনে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের সংসদীয় আসনগুলোর মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে বিভিন্ন সংসদীয় আসনের প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
তারা নিয়মিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার থানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাজিরা দিচ্ছেন। ফলে আওয়ামী লীগের এ দুটি কার্যালয়ে বেড়েছে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনবান্ধব দল। দলটি সব সময়ই গণতন্ত্রের প্রশ্নে ছিল আপসহীন। এ দলটির রয়েছে আন্দোলন ও সংগ্রামের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস। তাই সাধারণভাবেই এ দলের মনোনয়ন পাওয়াটা অনেকটা গৌরবের। তাছাড়া সর্বশ্রেণির মানুষ এদলের কর্মী।
তাই তারাও মনোনয়ন দাবি করতেই পারেন। যে কারণে আপনারা দেখতে পেয়েছেন ৩ হাজারের ওপরে মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে আমাদের দলীয় সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে। মনোনয়ন বোর্ড সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেবে। যার এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাকেই নির্বাচন করা হবে।
এদিকে দলীয় মনোনয় ফরম বিক্রিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। সকাল থেকে রাত অবধি নেতাকর্মীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকছে দলীয় কার্যালয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা সদলবলে এসে মনোনয়ন ফরম ক্রয় করছেন। অনেক প্রার্থীর স্বজনরাও প্রার্থীর পক্ষে মনোনয়ন ক্রয় করছেন। তবে শেষ দিনে ক্রয়ের চেয়ে জমা দিতেই বেশি দেখা গেছে। এসম প্রার্থীদের সদলবলে শোডাউন দেন।
মনোনয়ন ফরম বিক্রিকে কেন্দ্র করে বাড়ানো হয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েল ভেতরের নিরাপত্তা। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছড়া কার্যালয়ের সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে লাইন করে দেয়া হয়েছে। সেই লাইন ধরে প্রার্থী ও সমর্থকরা ঢুকছেন কার্যালয়ের ভেতরে। প্রবেশ মুখেই পড়তে হচ্ছে পুলিশের চেকিংয়ের মুখে।
এছাড়া দলটির মনোনয়নকে কেন্দ্র করে গুলিস্তান এলাকার সড়কগুলোতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখা গেছে। বাসে-পিকাপে করে নেতাকর্মীরা আসছেন দলটির মনোনয় সংগ্রহে। এছাড়া অনেক প্রার্থী তাদের কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা রাখতে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগের কার্যালয় এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, অনেক প্রার্থীর সমর্থকরা বাহারি রঙের টি-শার্ট, গেঞ্জি, ক্যাপ পরে এসেছে। এসব পোশাক সাজানো হয়েছে পছন্দের প্রার্থীর ছবি ও লেখা দিয়ে। সব নেতাকর্মীদের চোখে-মুখেই লেগে ছিল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এ অফিস ঘিরেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচরণ, উৎসাহ, আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই, ত্যাগ-তিতিক্ষা— সবকিছুতেই আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্বস্ত ঠিকানা হলো বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। এ কারণে এ জায়গাটিতে এত মানুষের আগমন ঘটছে।
তিনি বলেন, অনেকে আসছে কেমনভাবে মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়, তা দেখার জন্য বা কারা কেনে তা জানার জন্য। আবার অনেকে আসে উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য। বাংলার জনগণ সব চাপকে মোকাবিলা করবে। নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করে। এ আয়োজনে বাংলাদেশের মানুষ ভোটে অংশগ্রহণ করবে। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মানুষ ভোট দেবে, এটা তার অধিকার। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, জোর করে, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার অধিকার কারও নেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও নিবাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। যোগ্য নেতৃত্বের কোনো অভাব নেই। যারা নতুন প্রজন্ম, শিক্ষিত, ইয়াং, ভালো— নৌকার পরিবারের, যাদের নৌকার রক্ত। যাদের বাবা-চাচা-মা আওয়ামী লীগ করে আসছে— এদেরও বিবেচনা করা হবে।’ নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ