ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মিলে গেলেন দেবর-ভাবী

প্রকাশনার সময়: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০২

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জাতীয় পার্টির (জাপা) ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে অবশেষে এক হচ্ছেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। ফলে চার মাস ধরে চলমান জাপার অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংকট অনেকটাই সমাধানের পথে।

ক্রমেই দৃশ্যমান ভাবে এক হচ্ছেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। মান-অভিমান ও দ্বন্দ্ব ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে পার্টি চালাতে একমত পোষণ করছেন দেবর-ভাবী। দুইজনই চান জাতীয় পার্টিতে ভাঙন না ধরুক। ফলে আসছে ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একই মঞ্চে উপস্থিতি থাকবেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। ঐকবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন দুইজনই। সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আসছে নতুন মেরুকরণ।

জানা যায়, রাজধানীর কাকরাইল পার্টি অফিসে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বেগম রওশন এরশাদ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জি এম কাদের সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। রওশনপন্থি যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারাও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন মঞ্চে থাকবেন। তবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে জি এম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সে কারণে তার মঞ্চে থাকা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। তবে এরইমধ্যে জি এম কাদেরের উপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে তিনিই সভাপতিত্ব করবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন কাদেরপন্থি ও রওশনপন্থিরা। গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতিতে রওশন এরশাদের বাসায় জি এম কাদের ও পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বৈঠক করেন। তবে বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কোনো কথা বলেননি।

এর আগেও দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জিএম কাদের-রওশন এরশাদের বৈঠক হয়। তবে সবকিছুই শর্তের বেড়াজালে এতদিন আটকে ছিল। মিট মীমাংসার জন্য সর্বশেষ মঙ্গলবার কাদেরপন্থি ও রওশনপন্থিদের ৫ জন করে যৌথ মিটিং করেন। সেখানে লিখিত ও মৌখিকভাবে শর্ত দিয়েছেন উভয় পক্ষই। টেবিলে জি এম কাদেরের আদালত নিষেধাজ্ঞা ও মামলা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। রওশন এরশাদ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে দুই পক্ষই।

মৌখিক শর্তের মধ্যে রয়েছে— পার্টিতে কোন কোন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না, আর কোন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। লিখিত আকারে দাবি-দাওয়ার মধ্যে রয়েছে— যাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তাদের নাম জমা দেয়া হয়েছে। প্রেসিডিয়াম সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংগঠনিক সম্পাদক কোন পদে কে বসবেন।

যেমন— সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুর ইসলাম নুরু, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজুসহ কয়েকজনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে রওশন এরশাদের দুর্দিনে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের অনেকের নামও তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে— জাতীয় ছাত্রসমাজের সাবেক সভাপতি খন্দকার মনিরুজ্জামান টিটু, রওশন এরশাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ রুনাসহ অনেকের নাম বাদ পড়েছে। এমনকি এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনূর রশীদের নাম দিতে তারা কারপন্ন করেছেন। পরবর্তীতে রওশন এরশাদের হস্তক্ষেপে কাজী মামুনের নাম জমা দিয়েছেন। ফলে রওশন ও জি এম কাদের একত্রিত হওয়ায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেকেই জাতীয় পার্টি থেকে বাদ পড়তে পারেন— এমন শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, রওশন এরশাদের পক্ষে প্রকাশ্য যারা অবস্থান নিয়েছেন তারা হয়তো পার্টির মূল স্রোতে ফিরে আসতে বাধার মুখে পড়তে পারেন।

জানা যায়, সাবেক ছাত্রনেতা ইকবাল হোসেন রাজুর সঙ্গে কয়েক দফা মিটিং করেছেন পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এবং রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ সঙ্গে বৈঠক করেছেন অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া। বৈঠকগুলোর এজেন্ডা ছিল— রওশন ও জি এম কাদেরকে কীভাবে একত্রিত করা যায়, পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কীভাবে একসঙ্গে পালন করা যায়।

চুন্নু নাকি ইকবাল হোসেন রাজুকে প্রস্তাব দিয়েছেন সব ভুলে গেলে তাকে তারা মূল দলে নিয়ে নেবে। তবে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরপন্থিরা দৃশ্যমান এক হলেও তারা কি আসলেই মন থেকে এক হচ্ছেন— এমন প্রশ্ন তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

তারা বলছেন, রওশন এরশাদ কখনও বিতর্কিত ছিলেন না, দলে বিভেদ চাননি। পার্টিতে ভাঙনও চাননি। পারিবারিক দিক দিয়েও রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের একই আছেন। এখানে মূলত যারা পদ পাননি, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তারা পার্টিতে নিজেদের আবারও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।

যার কারণে পার্টিতে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। ফলে এখন তাদের দলে নিলেও মনে থেকে কি মেনে নেয়া হবে? ফলে মনে মনে প্রত্যেকের ক্ষোভ থাকার কারণে আবারও একটা সময় তা প্রকাশে চলে আসবে, পার্টিতে ফাটল দেখা যাবে বলেও মনে করছেন অনেকেই।

জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা নয়া শতাব্দীকে, ম্যাডাম রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মধ্যে কোনোকালেই দ্বন্দ্ব ছিল না। পারিবারিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কখনোই ছিল না। এমনকি কখনও দলে ভাঙন চাননি ম্যাডাম। দলকে সবসময় ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন তিনি। এটাও জি এম কাদের চান। পারিবারিক দ্বন্দ্ব তো সব পরিবারেই থাকে, এটা ভিন্ন জিনিস। জাতীয় পার্টি এক থাকবে এটা সুস্পষ্টভাবে এটা আমাদের সবাইকে বলে দিয়েছেন ম্যাডাম। এখানে কারও কোনো দ্বিমত নেই।

তিনি আরও বলেন, জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে থাকবেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের, ইনশাআল্লাহ। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু নয়া শতাব্দীকে বলেন, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ থাকবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন।

তিনি বলেন, পার্টিতে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভেদ নেই। জাতীয় পাটি ঐক্যবদ্ধ আছে, কোনো অনৈক্য নেই। আগেও ঐক্যবদ্ধ আছে, এখনও আছে। দলের বাইরে কারও কোনো দ্বন্দ্ব থাকলে এটা পার্টির বিষয় নয়। বাইরের কে কী করল এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।

জাপার সূত্রমতে, চলমান সংকট সমাধানে আগামী এক বছরে দলের কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের সমন্বয়ে পরিচালিত হবে পার্টি। যৌথ বৈঠকে দল থেকে যেসব নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের দলে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

এছাড়া দলের সব কার্যক্রম বেগম রওশন এরশাদের পরামর্শ নিয়ে জি এম কাদেরকে পরিচালনা করতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রদানের বিষয়টিও রওশন এরশাদের পরামর্শে পার্লামেন্টারি বোর্ড করবে। নির্বাচনি জোট কিংবা এককভাবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করবে কিনা সে বিষয়টিও রওশন এরশাদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে দেবর-ভাবীর মধ্যে চেয়ারম্যান পদ বা নেতৃত্ব নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন হয়নি।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ