বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অন্তরীণ। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সরাসরি অংশ নিতে পারছেন না রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমানও ফেরারি। লন্ডনে বসে পরিচালনা করছেন দল। দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ায় ফিরতে পারছেন না দেশে।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী এবং প্রচার সম্পাদক (মুখপাত্র) শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীও কারাগারে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ঢাকার মহানগরের আহ্বায়ক আবদুস সালামসহ দলের বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতা কারাগারে।
রাজনৈতিক মামলায় কারাগারে গেলেও তাদের মুক্তি নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। ফলে নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছে বিএনপি।
যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও নীতি-নির্ধারণে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পরিষদ আছে। কারাগারে গেলেও বিএনপির আন্দোলন চলমান থাকবে।
অবশ্য দলটির নেতারা এও বলছেন, বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতে গত ১৩ বছর যাবৎ চেষ্টা করে আসছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া, তারেকসহ জিয়া পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে অতীতে পারেনি, আগামীতেও পারবে না। মাঠের রাজনীতিতে ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ড নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় ৭ বছর, ১০ বছর এবং একটিতে যাবজ্জীবন সাজা দেয় আদালত।
ফেরারি থাকা সত্ত্বেও লন্ডন থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটি ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের সমন্বয়ে দলকে পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু গত ৭ ডিসেম্বর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং ৯ ডিসেম্বর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হলে কর্মসূচি সমন্বয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা গ্রেফতার হলে নেতাকর্মীদের মনোবল যাতে শক্ত থাকে তার জন্য তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন তারেক রহমান। এমনকি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। জিয়াউর রহমান নিহত হলে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন বেগম খালেদা জিয়া। ’৮৪ সালের ১০ মে দলটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনাসহ রাজনীতিতে বিএনপির শক্ত অবস্থান জানান দেয়া ছিল বেগম জিয়ার জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।
চার দশকে বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় আসা, বিরোধী দলে থাকা এবং সংসদের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতাও রয়েছে দলটির। জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বিএনপিতে জিয়া পরিবারের নেতৃত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর রাজনীতিতে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় জিয়া পরিবারের।
একের পর এক মামলার খড়গ পিছু ছাড়েনি তাদের। গত ২ নভেম্বর একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধেও। বিএনপি যখনই মাঠের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখনই ফের শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের নতুন মামলা ও পুরোনো মামলায় হয়রানি ও গ্রেফতার করছে পুলিশ।
ফলে মাঠে রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের দাঁড় করোনাটাই বিরাট এক চ্যালেঞ্জ বিএনপির সামনে। জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে কারোর তুলনা হয় না। হয়তো তিনি দেশে নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের কারণে তিনি নিয়মিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
তবে, মহাসচিবসহ যেসব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মতো করে কাজ করার লোক নেই। তারপর যারা যুগ্ম মহাসচিব আছেন তারা বিদ্যমান। স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টারা আছেন। তাই গণতান্ত্রিক কোনো সমস্যা হবে না। তিনি আরও বলেন, সরকার মনে করেছে তাদের গ্রেফতার করলে দলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমরা এখন আরও বেশি ঐক্যজোট। যার প্রমাণ গোলাপবাগের জনসভা। এত গ্রেফতার, বাধা সত্ত্বেও জনগণ জানান দিয়েছে এ সরকারকে মানুষ আর চায় না। কার্যত বিএনপিতে কোনো সংকট নেই।
বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এ সরকার এতটাই ফ্যাসিবাদী যে, গত ১৫ বছর যাবৎ বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য এমন কিছু নাই যে করে নাই। নেতৃত্বশূন্য করতে খালেদা জিয়া ও তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হাস্যকর মামলা দিয়ে সাজা দিয়েছে। নেতৃত্বহীন করার অনেক চেষ্টা করেছে। এগুলো আমরা অভ্যস্ত। হতাশ থাকার কথা থাকলেও আমরা হতাশ নই। আমাদের বিরুদ্ধে যত অত্যাচার হচ্ছে, অবিচার হচ্ছে আমরা তত বেশি শক্তিশালী হচ্ছি।’ নেতৃত্বহীন বিএনপি এবং দিকশূন্য রাজনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অস্বীকার করার কিছু নেই যে, মহাসচিবসহ যেসব সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা দলের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দুর্বল করার জন্য বেছে বেছে সেই নেতাদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, আমরা থাকলাম কি থাকলাম না, এতে কিছু আসে যায় না। দেশের জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। তারাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ নস্যাৎ করতেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু জনস্রোত কি ঠেকাতে পেরেছে? নেতৃত্বশূন্য হলেও বিএনপি দুর্বল হবে না। বিএনপি দিকশূন্য নয়। সরকার এর আগেও বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করেছে, পারেনি। বরং এগুলো করতে গিয়ে আওয়ামী লীগও দিকশূন্য হয়ে পড়েছে।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ