ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইউরোপের টোপে সর্বস্বান্ত অর্ধশত

প্রকাশনার সময়: ২০ জুলাই ২০২২, ১০:২৯

২০২০ সালে এইচএসসি পাস করেছেন মো. সায়হান দেওয়ান। এরপর আর দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি। তার আশা ছিল পাড়ি জমাবেন স্বপ্নের ইউরোপে। সেই ইচ্ছা থেকে খবর পান পল্টন এলাকার একটি অফিসের। যারা সায়হানকে ইউরোপের দেশ রোমানিয়াতে পাঠাতে পারবেন। তবে সে জন্য টাকা লাগবে সাত লাখ টাকা। সেই সাত লাখ টাকার মধ্যে ধারদেনা করে দেড় লাখ টাকা পরিশোধও করেন তিনি। বাকি টাকাও অতি শিগগিরই দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সায়হানের ইউরোপের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গত রোববার তিনি জানতে পারেন তাদের রোমানিয়ায় পাঠাতে চাওয়া সেই ব্যক্তি র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। শুধু এক সায়হান নয়, শহিদুল (ছদ্মনাম), রোমান আহমেদ, আসিফ নুর, রিয়াজ, পারভেজদের মতো প্রায় অর্ধশত মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। শুধু স্বপ্ন ভঙ্গই নয়, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধার ও জমি বিক্রি করা টাকা দিয়ে তারা সবাই প্রায় নিঃস্ব।

গত সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় গ্রেফতার মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের হোতা মো. আবুল কালামকে। এ সময় ৩০ জন ভুক্তভোগী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কয়েক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় নয়া শতাব্দীর। এরমধ্যে আসিফ নুর ও পারভেজ সম্পর্কে ফুফাতো ও মামাতো ভাই। দুজনের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। দালাল মারফতে জানতে পারেন, রাজধানীর পল্টন এলাকায় আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তি স্বল্প খরচে রোমানিয়া পাঠাচ্ছেন। সে ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে তারা আবুল কালামকে বিভিন্ন সময়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। নুর ও পারভেজের যাওয়ার কথা ছিল রোমানিয়ায়। এজন্য জমি বিক্রি ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে এই টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। টাকা দেয়ার পর গত দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে। তখন থেকে তাদের ঘোরানো হচ্ছিল। পারভেজ নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমি আগে গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। রোমানিয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জমি বিক্রি, ধারদেনা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে আবুল কালামকে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কল্পনাও করতে পারিনি আমি প্রতারিত হব। কিন্তু যখন আমাদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করা হয়, এরপর বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে বুঝতে পারি। ধারদেনা ও ব্যাংক ঋণ করে টাকা নিছি। টাকা শোধ করব কীভাবে? আমাদের বিএমইটি কার্ডগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম সব জাল। এখন মানুষ বাসায় এসে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। মানুষের আজেবাজে কথা শুনে আমার মা স্ট্রোক করেছে। গত কয়েক দিন ধরে বাড়িতে যেতে পারছি না। আমাদের রোমানিয়ার কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা নিছে। প্রথমে বলছে রোমানিয়া পাঠাবে। এজন্য সাত লাখ টাকা দিতে হবে। আমরা টাকা দিলে একটা ওয়ার্ক পারমিটের কাগজ দিয়ে বলেছে এটা দিয়ে ভারতে যেতে পারবে। পরে আমরা বললাম ভারতে যাব না। আমাদের পাসপোর্ট ফেরত দেন। তখন সে বলল, তোমাদের কাজ হয়ে গেছে। ভারত থেকে ভিসা লাগিয়ে নিয়ে আনতেছি। এরপর ভুয়া বিএমইটি কার্ড দিয়া বলল তোমরা ট্রেনিং কর ও ফিঙ্গার দাও। আমি তোমাদের ম্যানপাওয়ার করে দেব। তোমরা ঈদের আগেই রোমানিয়া চলে যেতে পারবে। ঈদের আগে ফ্লাইট করে দেবে বলে আরো দুই লাখ টাকাসহ মোট পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে।

ভুক্তভোগী আসিফ নূর নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমি দিয়েছি দেড় লাখ আর আমার মামাতো ভাই দিয়েছে আড়াই লাখ টাকা। সবমিলে পাঁচ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল। আমি আবুল কালামের প্রতারণার বিষয়টা আগে ধরতে পেরেছিলাম। অনেককে বলেছি, কিন্তু তারা বলেছে, না। যখন আমাদের বিএমইটি কার্ড দিল তখন দেখতে পারলাম এই কার্ড ভুয়া। পরে আমরা জনশক্তি রফতানিকারক অফিসে গিয়ে যাচাই করি। এরপর সেই কার্ড ভুয়া বিষয়টি ধরা পড়ে।

এই দুই ভাইয়ের মতো প্রতারিত মুন্সীগঞ্জের আরেক যুবক রোমান আহমেদ জানান, এলাকায় একটি মুদিদোকান চালাতেন। রোমানিয়া যাবেন এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে তড়িঘড়ি করে সেই দোকানের মালামাল বিক্রি করেছেন। দোকান বিক্রির টাকা বুঝিয়ে দেন আবুল কালামের হাতে। এই প্রতারকের পাল্লায় পড়ে রোমানিয়ার স্বপ্নে অনেকে নিজের কেনা টাকায় এলাকায় চালানো অটোরিকশা বিক্রি করেছেন। বিক্রি করেছেন নিজের দোকান, আবার কেউ নিজের ভিটেমাটি ও আবাদি জমি। তার মতো ছয় যুবক মিলে তারা আবুল কালামকে ১৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বলে জানালেন রোমান আহমেদ।

এ টাকা দেয়ার পর আবুল কালাম তাদের জানিয়েছিলেন, ঈদের আগে ফ্লাইট হবে, কিন্তু হয়নি। এখন রোমানিয়ার স্বপ্নে যে টাকা দিয়েছিলেন সেই টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন তার মতো অন্যরা। রোমান আহমেদ জানান, শুধু তার এলাকাতেই ১৪ জন আবুল কালামকে রোমানিয়া যাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছে। তার তথ্যমতে, ৩৩ জন আবুল কালামকে তিন লাখ টাকা করে দিয়েছিল।

রোমান, আসিফদের মতো এত বেশি টাকা না দিলেও শহিদুল (ছদ্মনাম) সম্প্রতি দিয়েছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপরাগতা জানান।

তার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি যে এখানে টাকা দিয়েছি সেটা আমার পরিবার জানে না। এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভিসা হলে পরিবারকে জানিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বন্ধুকে দিয়ে দেব। এখন আমার পরিবার যদি দেখে আমি এখানে তাহলে আমার সমস্যা হবে। পরে যখন তার পরিচয় গোপন রাখা হবে জানানো হলে তিনি আশ্বস্ত হন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত। পড়ালেখা না জানায় তারা যে প্রতারিত হচ্ছেন, বিষয়টি যাচাই করতে পারেননি। আর যারা যাচাই করে ভিসা ও বিএমইটি কার্ড ভুয়া বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন তারা সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। গত দুই বছর থেকে তাদের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হবে বলে জানাচ্ছিলেন।

র‍্যাব জানিয়েছে, রোমানিয়ায় পাঠানোর কথা বলে শুধু নূর ও পারভেজ নয়, তাদের মতো ৩০০ মানুষের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত হাতে নিয়েছেন প্রতারক আবুল কালাম। এরমধ্যে প্রায় অর্ধশত লোক পথে বসে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও রোমানিয়া পাঠানোর কথা বলে গত তিন বছরে তিনি তিন কোটি টাকার বেশি হাতিয়েছেন। গত সোমবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, জনশক্তি রফতানির লাইসেন্স ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে চাকরির প্রলোভনে ভুয়া ভিসা-নকল বিএমইটি কার্ড দিয়ে প্রতারণা করত একটি চক্র। এসব কার্ড দেখিয়ে বেকার যুবক-যুবতীদের কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিতেন তারা। ভুক্তভোগীরা ভুয়া ভিসা ও নকল বিএমইটি কার্ড নিয়ে বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা ও বিএমইটি কার্ড নকল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিত। গত তিন বছরে চক্রটি ৩০০ লোকের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল গত রোববার রাতে রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের হোতা মো. আবুল কালামকে গ্রেফতার করে। এ সময় ১৪টি পাসপোর্ট, ৬টি নকল বিএমইটি কার্ড, আর্থিক লেনদেনের বিভিন্ন লেজার, রেজিস্টার ও ডায়েরি জব্দ করা হয়।

তিনি বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব-৩ জানতে পারে, পল্টন এলাকায় একটি মানবপাচার ও প্রতারক চক্র মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া ভিসা ও নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে বিদেশ যেতে ইচ্ছুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করেছে। সহজ-সরল বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিরা ওই ভুয়া ভিসা ও বিএমইটি কার্ড বিমানবন্দরে প্রদর্শন করার পর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা ও বিএমইটি কার্ড জাল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ রকম কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব-৩ গোয়েন্দা নজরদারি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আবুল কালাম সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। তার জনশক্তি রফতানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রফতানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক পাঠিয়ে আসছে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ