ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পশুর উচ্ছিষ্টে নতুন সম্ভাবনা

প্রকাশনার সময়: ১৪ জুলাই ২০২২, ১২:৩১

ঈদের পরই রাজধানীতে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্টের রমরমা ব্যবসা। এ ব্যবসায় দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। একসময় কোরবানি দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলি ও চর্বি ফেলে দেয়া হতো; কিন্তু এগুলো এখন আর ফেলনা নয়। এসব বর্জ্য থেকেই হচ্ছে কোটি টাকার বাণিজ্য। আর এ ব্যবসায় ব্যস্ত সময় কাটছে নগরীর হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার বেপারিদের। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ব্যবসা থেকে বছরে শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, পশুর উচ্ছিষ্টের মধ্যে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জাপান ও চীনে গরু-মহিষের পেনিস বা লিঙ্গ অত্যন্ত দামি বস্তু। এ দিয়ে তৈরি স্যুপ ওই সব দেশে খুবই জনপ্রিয় ও দামি খাবার। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে পশুর একেকটি লিঙ্গ ৮-১০ ডলারে বিক্রি হয়। এ ছাড়া গরু-মহিষের দাঁত ও হাড় থেকে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কাভার। সূত্র মতে, জবাইয়ের পর একটি গরুর আকারভেদে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। অথচ চীন ও থাইল্যান্ডে গরুর হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে হাড়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। হাড় দিয়ে ওষুধ, সিরামিক, পণ্যসামগ্রী, বোতাম ও ঘর সাজানো উপকরণ তৈরি করা হয়; কিন্তু অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। অথচ কোরবানিসহ সারা বছর জবাই করা গরুর হাড়ের মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পশুর হাড় দিয়ে ওষুধ ক্যাপসুলের কাভার, মুরগি ও মাছের খাবার, জৈব সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরি হয়। নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের খুর দিয়ে অডিও ভিডিওর ক্লিপ, অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুল। গরুর রক্ত শুকিয়ে ব্লাড মিল তৈরি করা যায়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহূত হয়। এ ছাড়াও জার্মানি ও ইতালিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

রাজধানীতে রয়েছে পশুর উচ্ছিষ্টের বিশাল বাজার। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে রয়েছে দুটি বাজার একটি জিঞ্জিরায়, অন্যটি হাসনাবাদ এলাকায়। আগে কেবল ঢাকার আশপাশ থেকে এই বাজারে শিং ও হাড় এলেও এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এই বাজারে আসছে গরু-মহিষের শিং ও হাড়। এখানে প্রতি মণ শিং ৬০০ টাকা ও প্রতি মণ হাড় বিক্রি হয় ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা দরে। তাছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তিন টাকা কেজি দরে পশুর হাড়, ২০-৩৫ টাকা দরে পশুর অণ্ডকোষ, ১২০ টাকা দরে পাকস্থলি, শিং ১০০ টাকা, চোয়ালের হাড় তিন টাকা কেজি দরে কিনে নেন ব্যবসায়ীরা।

হাজারীবাগের হাড় ব্যবসায়ী রবিউল আলম বলেন, বছরে একবারই আমরা এ ব্যবসাটা করি। বহুল প্রচারিত নয়, তারপরেও ভালো দাম পাই বলে বছরে একবারই এসব সংগ্রহে নামি। আমরা এগুলো সংগ্রহ করে কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিক্রি করি। এগুলো কেনার জন্য লোকজন আসেন। তাই বিক্রিতে ঝক্কি-ঝামেলা নাই, দাম ভালো। তবে গরুর হাড়, শিং, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রনালি, চর্বি, রক্তের মতো বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে এগুলো দেশেই কাজে লাগানো যেত। দুইমণ ওজনের প্রতিটি গরু থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরির জন্য ২০ কেজি বর্জ্য তৈরি হয়। পেনিস ও গোল্লা (ভুঁড়ি) রফতানি হয়। প্রতিটি পেনিসের রফতানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার ও গোল্লার মূল্য ১০-১২ ডলার। পশুর বর্জ্যের বড় বাজার হলো থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন ও জাপান।

তিনি বলেন, স্থানীয় ওষুধ শিল্পের জন্য হাড়ের চাহিদা রয়েছে। এগুলোকে হাজার কোটি টাকার সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। সরকারের পাশপাশি ওষুধ উৎপাদনকারী বেক্সিমকো, অপসোনিনসহ স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে পরিবেশ দূষণমুক্তের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

উচ্ছিষ্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা: রাজধানীর, হাজারীবাগ, গুলশান, মহাখালী, পুরান ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া পশুর বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন কসাই, পথশিশু, পরিচ্ছন্নকর্মী ও ফেরিওয়ালারা। পুরান ঢাকার হাজারীবাগের হাড্ডিপট্টিতে পশুর এসব বর্জ্য কেনার জন্য ৩০ থেকে ৪০টি ভাঙাড়ির দোকান রয়েছে। সেসব দোকানে গরু-মহিষের হাড় ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনা চলে। উচ্ছিষ্ট বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলি ও চর্বি। হাড়, মাথা, দাঁত বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে, আর শুকনো হাড়ের কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা। কেজি হিসেবে পশুর অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ ২৫ থেকে ৪০ টাকা, শিং ৬০ থেকে ৮০ টাকা, চর্বি ৩০ থেকে ৬০ টাকা, রক্ত ৮ থেকে ১৫ টাকা।

বর্তমানে দেশে জবাইকৃত গরু মহিষ ছাগলের মাংস ও চামড়া ছাড়া অবশিষ্টাংশ বিদেশে রফতানি করে আয় হচ্ছে ২৯০ কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে মোট বর্জ্যের মাত্র ২০ শতাংশ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকি ৮০ শতাংশ পচে-গলে নষ্ট হচ্ছে এবং পরিবেশকে দূষিত করছে। পুরো বর্জ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা গেলে এ খাত থেকে বছরে ১ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে জানা যায়, গরুর প্রজনন অঙ্গ অত্যন্ত দামি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এক-একটি অঙ্গ ছয় থেকে সাত ডলারে বিক্রি হয়। প্রতিটি অণ্ডকোষের রফতানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, পশু জবাইয়ের পর একটি মাঝারি আকারের গরুতে ১৫ থেকে ২০ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। আমরা জানিই না যে, প্রতিদিন এই হাড় নিয়ে বাণিজ্য হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ এবং নাড়িভুঁড়ি বিক্রি হয় প্রায় ২০ লাখ টাকার। উচ্ছিষ্ট অংশকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠছে নানা শিল্প-কারখানা, বাড়ছে রফতানির সম্ভাবনা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, শুধু কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী এক মাসে সারাদেশে প্রায় ২৫ হাজার টন পশুর হাড় সংগ্রহ করা হয়। প্রকারভেদে প্রতি কেজি গরুর শিংসহ হাড় বিক্রি হয় ১০ থেকে ২৫ টাকা হিসেবে প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।

বাংলাদেশ বোন এক্সপোর্টার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রতিদিন এই হাড় কেনাবেচায় কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। জবাই করা পশুর ফেলে দেয়া হাড়গোড় সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করে হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আরেকটি পণ্য নিয়ে দেখা দিয়েছে অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপকরণের উৎস পশুর উচ্ছিষ্ট: পশুর কোনো কিছুই ফেলনা নয়। ১২ ঘণ্টা চুলার আগুনে পশুর অপ্রচলিত চর্বি জ্বালিয়ে বের করা হয় তেল। কোরবানির পশু থেকে সংগ্রহ করা এসব কমার্শিয়াল ফ্যাট বিভিন্ন কল-কারখানার কাজে ব্যবহার করা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পশুর অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি সুসেড রোলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য।

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে প্রায় ১৫০টি ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ক্যাপসুল তৈরি করে। বেশ কিছু কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের সেল তৈরি করে।

বাংলাদেশ বোন এক্সপোর্টার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অন্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, চর্বি বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে শিল্প-কারখানায়। পশুর হাড় দিয়ে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, ক্যাপসুলের কভার, বোতাম, সিরামিক পণ্য, মেলামাইন, খেলনা, শোপিসসহ ঘর সাজানোর নানা উপকরণ, নাড়ি দিয়ে- অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে- পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে- সাবান, পায়ের খুর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্লিপ ইত্যাদি উপকরণ তৈরি হয়। পিত্ত থলি দিয়ে তৈরি হয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। আন্তর্জাতিক বাজারে যার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাপান, চীন, কোরিয়া আর থাইল্যান্ডে উপাদেয় খাবার সুপ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় গবাদিপশুর লিঙ্গ। ৪ থেকে ৬ ডলারে বাংলাদেশ থেকে পশু লিঙ্গ কিনে নেয় এসব দেশ। এগুলোই বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা রফতানি হয়। নাড়িকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের জনপ্রিয় খাবার সুসেড রোল। হাড়, খুর, দাঁত, শিং আর রক্ত দিয়ে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কভার, জেলোটিন, ক্যামেরার ফিল্ম, সিরিজ কাগজ আর পশুপাখির খাবার। দেশেই ওষুধ কোম্পানি অপসোনিন তৈরি করছে ক্যাপসুলের কাভার। মাথার হাড় মেলামাইন তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। পশুর শিং দিয়ে তৈরি হয় চিনাংনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর শো-পিস।

কোরবানি ঘিরে বিশাল বাণিজ্য: বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির গবেষণা অনুযায়ী, কোরবানি ঈদে শুধু ঢাকা শহরেই উৎপাদিত হয় ৩৫ হাজার টন বর্জ্য। কোরবানির বর্জ্য হলো হাড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, রক্ত চর্বি, পিত্ত এবং চামড়ার ওয়েস্টেজ অংশ। এসব উচ্ছিষ্ট শতভাগ রফতানিযোগ্য। এগুলো রফতানি করলে শতকোটি টাকা আয় করা সম্ভব শুধু কোরবানি ঈদকেন্দ্রিক।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যে জানা যায়, কোরবানির বর্জ্য দিয়ে উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করলে মাটির উর্বরতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশু উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলছে, পশু ও মৎস্য খামারিরা প্রতি কেজি প্রোটিন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় আমদানি করে। অথচ কোরবানিসহ পশুর উচ্ছিষ্ট ও বর্জ্য ব্যবহার করে প্রোটিন উৎপাদন করলে প্রতি কেজি প্রোটিন উৎপাদনে খরচ হবে ৩ থেকে ৪ টাকা। এভাবে পশু ও মৎস্য খাদ্যের প্রোটিন চাহিদা পূরণ হবে এবং সাশ্রয় হবে কোটি কোটি টাকা।

রফতানি বাণিজ্যে অমিত সম্ভাবনা: পশুর উচ্ছিষ্ট ঢাকার ট্যানারি থেকে চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় রফতানি করা হয় তা জানেন না অনেকেই। হাজারীবাগের কিছু উদ্যমী মানুষ ময়লার স্তূপ থেকে গবাদিপশুর এসব উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে বিদেশে রফতানি করছেন। আবার বাংলাদেশের সিরামিক ও মেলামাইন তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো গুঁড়া ও দানা অবস্থায় কাঁচামাল হিসেবে হাড় পুনরায় আমদানি করে। এই হাড় বাণিজ্যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দূষণের হাত থেকে পরিবেশও রক্ষা হচ্ছে। দেশে ১ কোটি পশু কোরবানি হলে প্রতিটি গড়ে ১০ ডলার হিসেবে পাকস্থলি থেকেই অর্জিত হতে পারে প্রায় ১০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার কোটি টাকা। প্রতিটি গরু থেকে গড়ে ২০ কেজি হাড় ও ৫ কেজি অন্য অঙ্গ পাওয়া যায়। দেখা গেছে, বছরে গরুর উচ্ছিষ্টই উৎপন্ন হয় প্রায় ২৫ কোটি কেজি। এসব অঙ্গের মাত্র ১০ শতাংশও রফতানি করা সম্ভব হয় না। রফতানিকারকরা মনে করেন পশুর বর্জ্য রফতানিতে সরকারের সহায়তা পেলে কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।

তথ্য-উপাত্তে জানা গেছে, পশুর পাকস্থলি একটু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিলেই এর দাম দাঁড়াবে ১০ থেকে ১২ ডলার। গবাদিপশুর লিঙ্গ থেকে রফতানি আয় হতে পারে পাঁচ কোটি ডলার। জার্মানি, ইতালিতে পশুর শিং এবং গরু, মহিষ, ভেড়া, খাসির অন্ডকোষের পাউডার জাপান, চীন ও কোরিয়া, মিয়ানমার ও হংকংয়ে রফতানি করা হয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেও আসতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।

হাড়ের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে ক্যাপসুল সেল: পশুর হাড় থেকে তৈরি হচ্ছে ক্যাপসুলের সেল, মুরগির খাবার ও জমির সার। ক্যাপসুলের সেল বা আবরণের ভেতরে থাকে ক্যাপসুলের ওষুধ।

জানা গেছে, দেশে মোট প্রায় ২০০টি ওষুধ কোম্পানিতে ক্যাপসুল সেলের প্রয়োজন হয়। বিদেশেও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। অপসোনিন গ্লোবাল ক্যাপসুল সেল গুঁড়া করা হাড় কিনে জিলাটিন বানিয়ে তা থেকে তৈরি করে ক্যাপসুলের সেল। এসব কাজে প্রতি মাসেই প্রয়োজন হয় কয়েকশ’ টন পশুর হাড়। প্রতি ঈদে কোরবানির পশুর হাড় দিয়ে এ চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ পূরণ হয়।

জানা গেছে, দেশীয় ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ক্যাপসুল সেলের চাহিদা রয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি ক্যাপসুল সেল বিদেশে রফতানি হচ্ছে। পাকিস্তান, আমেরিকা, ইউক্রেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, সৌদি আরবসহ ১৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে ক্যাপসুল সেল।

কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় ডাস্টবিনে:

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি প্রতিটি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পশু কোরবানি করা হয়, তাহলে এসব উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করা সহজ হয়। সচেতন হলে এ খাতে কোটি কোটি টাকা রফতানি আয় সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকার চাইলে এই শিল্পখাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সংরক্ষণের আধুনিক সুবিধা আর সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা পেলে, অর্থের অঙ্কটা কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। ব্যবসায়ীদের দাবি, কোরবানির পশুর বর্জ্য রফতানি করেই হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। দরকার সরকারের সহায়তা। সাভার চামড়া শিল্প এলাকায় প্লট পেলে অপ্রচলিত পণ্যের তালিকায় শীর্ষ রফতানিকারক হতে পারবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু কোরবানির পশু থেকে এক হাজার মণ হাড়, ছয় হাজার কেজি লিঙ্গ ও ৫০০ মণ গোল্লা (নাড়িভুঁড়ি) গত বছর সংগ্রহ করা হয়েছিল। সাধারণভাবে সমিতি সারা দেশ থেকে মাসে আড়াইশ’ মণ হাড় সংগ্রহ করতে পারে। সেই হিসাবে বছরজুড়ে সংগ্রহ করা হাড়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে কোরবানির সময়। এ কারণে এ সময় বর্জ্য সংগ্রহে লোকবল বাড়ানো হয়।

মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, পশুর বর্জ্য-হাড়, শিং, চামড়া, ভুঁড়ি, পেনিস, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত-ইত্যাদি সবই রফতানিযোগ্য। অধিকাংশ রফতানি হয় চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে। তিনি আরো বলেন, এ বছর সার্বিকভাবে পশুর উচ্ছিষ্ট থেকে আয় দুইশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কেরানীগঞ্জের হাড় ব্যবসায়ী মো. সাব্বির হোসেন জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু ও মহিষের পেনিস সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পেনিসেরই রফতানি মূল্য ৮ থেকে ১০ ডলার।

গত মঙ্গলবার হাজারীবাগের কালুনগর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, আবিদান ব্রাদার্স নামক কারখানার সামনে হাড় এনে যেন ছোটখাটো এক পাহাড় জমিয়ে ফেলেছেন ফেরিওয়ালারা। কারখানা শ্রমিকরা সেসব হাড় মেপে মেপে কিনে নিচ্ছিলেন তাদের কাছ থেকে। প্রতি কেজি হাড়ের দাম দেয়া হচ্ছিল ৮-১০ টাকা করে। কারখানার সুপারভাইজার মোঃ ফারুক জানালেন, এ হাড় পরিষ্কার করে ভাঙ্গার পর অপসোনিন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে। দেশে এ একটি ওষুধ কোম্পানিই খোলাবাজার থেকে হাড় ক্রয় করে।

আবিদান ব্রাদার্সের মালিক মো. ভোলা মিয়া জানিয়েছেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় এ কারখানাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন সৈয়দপুরে কয়েকটি হাড় প্রক্রিয়াকরণ কারখানা তৈরি হয়েছে। সেখানে চিরুনিসহ অন্য হাড়জাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। গরুর প্রজননতন্ত্র মূলত মিয়ানমারে রফতানি করা হয়। সেখানে এর স্যুপ খুবই বিখ্যাত খাবার।

হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচরের একেকটা কারখানা বছরে ৫ থেকে ৬শ’ টন হাড় সংগ্রহ করে কাঁচাবাজার ও ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে। এর বেশিরভাগই ওষুধ কোম্পানি অপসোনিনে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া কিছু অংশ মিয়ানমার, ভারত, জাপান, ইরানসহ অন্যান্য দেশে রফতানিও হয়।

সারাদেশে ৩৫টির মতো কারখানা রয়েছে, যেখানে হাড় গুঁড়া করা হয়। রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়াও হাড় ভাঙার কারখানা আছে যাত্রাবাড়ী ও মৃধাবাড়ী এলাকায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে চারটি হাঁড়ের কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৩টি হাড় কারখানা প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার হাড় বিদেশে রফতানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। ৩টি কারখানাই বর্তমানে লাভজনকভাবে চলছে। এগুলো গত অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার পশুর হাড় রফতানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এখন হাড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ