ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চামড়া নিয়ে ‘পুরোনো খেলা’

প্রকাশনার সময়: ১৩ জুলাই ২০২২, ১৪:৫৩

চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়বহুল হয়ে ওঠায় দেশে চামড়ার ব্যবসায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি সরকার গত ৩ বছর যাবৎ চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও সেই দাম অনুযায়ী চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে না। অদৃশ্য এক সিন্ডিকেটের ফাঁদে হাবুডুবু খাচ্ছে কাঁচা চামড়ার ঈদের বাজার। বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, চামড়ার দাম নিয়ে যে আজব খেলা চলে, তার মাঠ তৈরি করেন ট্যানারি মালিক আর আড়তদাররা। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের তীক্ষ নজরদারি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন পূর্বক ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে এই শিল্প কালক্রমে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশে চামড়া ব্যবসায়ীদের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রধান মৌসুম ঈদুল আজহা। এক দশক আগেও যেখানে একটি গরুর চামড়া আকারভেদে ১২০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি করা যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই একই চামড়া ৫০০ টাকাতেও বিক্রি করতে পারছেন না মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। পরপর কয়েক বছর কাঁচা চামড়ার বাজারে এই অস্থিরতা দেখা দিলে সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া শুরু করে। তারপরও নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে কাঁচা চামড়া কিনতে পারছে ট্যানারিগুলো। পানির দরে না বিক্রি করে অসংখ্য চামড়া ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর কারণ হিসেবে চাহিদার চাইতে জোগান বেশি হওয়া ছাড়াও চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারার কথা বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আবার ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত করার খরচ এত বেড়ে গেছে যে সস্তায় কাঁচা চামড়া কিনলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম বাড়াতে হচ্ছে।

হাজারীবাগের মোতালেব সর্দার প্রতি বছর কোরবানির মৌসুমে এতিমখানা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে সেগুলো ট্যানারিতে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতেন। তার মতো আশপাশের আরো অনেকেই এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে, তিনি জানান, গত তিন বছর ধরে লাখ লাখ টাকা লস দেয়ার পর এবার আর এই ব্যবসা আর করবেন না।

নয়া শতাব্দীকে তিনি বলেন, ‘ধরেন বড় একটা ট্রাকে প্রায় ১০ লাখ টাকার চামড়া নিয়ে গেছি। ট্যানারি বলে যে দুই লাখ টাকায় দিলে দাও না হলে যাও। এভাবে অনেকে চামড়া ফেলে দিতে হয়েছে। কোনো দামই দেয় না। এভাবে গত বছর আড়াই লাখ টাকার মতো লস করেছি। পুরো ব্যবসাটা এখন সিন্ডিকেটের হাতে। তারাই সব লাভ করবে আর কাউকে ব্যবসা করতে দেবে না।’

বাংলাদেশে বেশির ভাগ কোরবানিদাতা তাদের জবাই করা পশুর চামড়া বিনামূল্যে মাদরাসা এবং এতিমখানায় দান করে থাকেন। এক সময় মাদরাসা ও এতিমখানা পরিচালনার একটি বড় খরচ এই চামড়া বিক্রির টাকা থেকে তোলা হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকে আর নির্ভর করছে না।

ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার এক কর্মকর্তা বলেন, আগে সব চামড়ার কম বেশি দাম পাওয়া যেত। কিন্তু এখন গরুর চামড়ার দামও অনেক কম। ছাগলের চামড়ার বলতে গেলে কোনো দামই নেই। আগে চামড়া কালেকশন করলে একটা ভালো ইনকাম হতো। কিন্তু সেটা এখন হচ্ছে না। তাই আমরাও আর চামড়ার টাকায় নির্ভর করি না। অনেক মাদরাসা কর্তৃপক্ষ চামড়ার দাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলার কথাও জানিয়েছেন।

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ঈদের আগের সপ্তাহে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার আগের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৭ টাকা ও খাসির চামড়া ৩ টাকা বেশি দরে কিনতে হবে ট্যানারি মালিকদের। অবশ্য চামড়ার দাম ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভিন্ন। ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া কিনতে হবে ৪৭-৫২ টাকায়, যা গত বছর ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বর্গফুট হিসেবে কিনেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এই দর তার আগের বছর বা ২০২০ সালে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪০-৪৪ টাকা দাম পড়বে। গত বছর এই দাম ছিল ৩৩-৩৭ টাকা। আর ২০২০ সালে ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা বর্গফুট। সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ হয়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। গত বছর এই দাম ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ১৩ থেকে ১৫ টাকা। তবে সরকারের এই নির্ধারিত দামে ভরসা নেই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। ভরসা দিতে পাচ্ছে না সরকারও। গত কয়েক বছর চামড়ার বাজারে অস্থিতিশীলতার পেছনের কারণ হিসেবে চাহিদার তুলনায় বেশি জোগান এবং চামড়া সংরক্ষণের দুর্বলতার কথা বলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

তিনি বলেন, আগের চেয়ে এখন কোরবানি হচ্ছে বেশি। একদিনে কোরবানি হওয়ায় অতিরিক্ত সাপ্লাই থাকে। সে কারণেই দাম ওঠে না। কোরবানি যারা দিচ্ছেন তারা যদি লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে চামড়াটি এতিমখানায় দিতেন তাহলে চামড়া তিন মাস পর্যন্ত ভালো থাকত, পরে দর কষাকষির সুযোগ থাকত। চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এবং পুরো চামড়া খাত বেসরকারি খাতের অধীনে হওয়ায় সেখানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।

তিনি বলেন, চামড়ার পুরো কাজটাই হয় বেসরকারি খাতে। সরকারিভাবে চামড়া কিনে রাখারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য আমরা জোর দিয়েছি লবণ মাখানো এবং স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করার ওপর। সেটা এতিমখানায় হতে পারে, জেলাগুলোয় বিসিকের যদি জায়গা থাকে সেখানেও হতে পারে। সরকার প্রতি বছর স্থানীয়ভাবে এবং জেলা পর্যায়ে চামড়ার সংরক্ষণাগার তৈরির প্রতিশ্রুতি দিলেও আজো তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।

ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেটার প্রভাব পড়ছে কাঁচা চামড়ার দামে। তাদের কথা— আগে প্রতি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ৩০ টাকার মতো লাগলেও এখন সেটা ৫০ টাকার মতো দাঁড়িয়েছে। প্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি কেমিক্যালের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে লবণের দামও। তিন মাস আগেও ৬০ কেজির এক বস্তা লবণের দাম ছিল ৪৫০ টাকা। সেটা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যে কারণে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের খরচও বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অল্প দামে হুবহু চামড়ার মতো আর্টিফিশিয়াল লেদার বা পিউ লেদার চলে আসায় চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা অনেকাংশে কমে গেছে বলে জানান একটি ট্যানারির মালিক সাব্বির আহমেদ।

তিনি বলেন, যেখানে রেডিমেড পণ্যের চাহিদা কমে গেছে, সেখানে কাঁচা চামড়ার বাজার বলতে গেলে নেই। প্রশ্ন উঠছে যে বাজারে যদি কাঁচা চামড়ার দাম এত কম হয় তাহলে চামড়াজাত পণ্যের দাম এত বেশি কেন? এ ব্যাপারে চামড়াজাত পণ্য ব্যবসায়ীরা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করার খরচ বাড়ার কথা তুলে ধরছেন।

সাব্বির আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার, কেমিক্যালের দাম, লবণের দাম, চামড়া প্রসেস করা, কারখানার শ্রমিকের খরচ—এসবের ওপর নির্ভর করে চামড়ার দাম। সব কিছুর দামই বাড়তি। সেই সঙ্গে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকাকেও এই কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হলেও সেখানে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সনদ এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনোটিই নেই বাংলাদেশের। এ কারণে ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ইউরোপে ঢুকতে পারছে না। যেটুকু রফতানি হচ্ছে, তাতে দাম পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য রফতানিকারক দেশের তুলনায় কম। সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলেও সেটা পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট করা হয়নি বলে জানিয়েছেন চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে ন্যায্য দামে রফতানির জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলছে না। সরকার যদি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করে তাহলে এই খাত লাভবান করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ