ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর পর কালীগঙ্গা

প্রকাশনার সময়: ৩০ জুন ২০২২, ১৪:৪২ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২২, ১৪:৪৯

‘আমরা অসহায়। নদীর জল কুচকুচে কালো আর লালচে হয়ে গেছে। কটু গন্ধ বেরোয়। এ দুর্গন্ধের কারণে আপনি নদীর পারে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারবেন না,’ বলেন বিধু। নদীর দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায় সাভার ট্যানারি শিল্পপল্লীর দূষিত পানি কালীগঙ্গা নদীর তীরস্থিত পারাগ্রামের বাসিন্দা বিধু হালদারের।

জানা গেছে, একসময় কালীগঙ্গায় মাছ ধরে পেট চালাতেন বিধু হালদার। কিন্তু নদী দূষিত হয়ে পড়ায় সেখানে আর মাছ নেই। তাই বিধু হালদার এখন দিনমজুরের কাজ করেন। কালীগঙ্গা নদীর ধারে পারাগ্রামের ৫৫ বছর বয়সি জেলে এই বিধু হালদার ও তার ২৪ বছর বয়সি ছেলে আরাধন হালদার স্থানীয় একটি দোকানে স্যানিটারি পণ্যের জন্য স্টিলের রড কাটছেন। ছেলের ধরে থাকা রড কাটারের ওপর হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত দিয়ে বিধু হালদার বলেন, আগে নদীতে মাছ ধরে পেট চালাতাম। কিন্তু পানি এখন এত বেশি দূষিত যে নদীতে আর কোনো মাছ নাই। তাই জীবিকার তাগিদে পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই দিনমজুরের কাজ করে পেট চালাতে হচ্ছে।

এছাড়াও দূষিত নদী বদলে দিয়েছে ৩৫ বছর বয়সি জেলে রতন ব্যাপারির জীবনও। ১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরা শুরু করেন রতন। কিন্তু নদীর এ অবস্থার কারণে তিনিও এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন নিজ এলাকায় রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

রতন ব্যাপারী বলেন, ছবির মতো সুন্দর এ গ্রামগুলোর জেলেদের জীবন চলত নদীতে মাছ ধরে। কিন্তু সেই দিন আর নেই। সাভার ট্যানারি পল্লীর দূষিত পানি কালীগঙ্গা নদীকে মেরে ফেলছে। সঙ্গে মরছে নদীতে থাকা মাছসহ সব প্রাণিকুল।

কয়েক বছর আগেও পারাগ্রামের মতো অনেক গ্রামের নদীর দু’ধারে ছিল গাছপালা আর ঘরবাড়ির সমারোহ। নদীতে গোসল, হাঁড়ি-পাতিল, জামা-কাপড় ধোয়ার মতো নিত্যদিনের কাজ সারত গ্রামবাসী।

৭২ বছর বয়সি মোহাম্মদ সিরাজের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবই পারাগ্রামে। নদীতে গোসল করা তার অভ্যাস। কিন্তু এখন শুকনো মৌসুমে আর তা পারেন না। টিউবওয়েলের পানি দিয়েই তাকে গোসলের কাজ সারতে হয়।

মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, শুকনার সময়ে নদীতে থাকা পানির দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝতে পারবেন, এ পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। একবার গায়ে ওই পানি লাগলে সারা শরীর চুলকাতে শুরু করবে আর হতে পারে চর্ম রোগ।

অভিযোগ রয়েছে, সাভার ট্যানারি শিল্পপল্লীর দূষিত পানি কালীগঙ্গা নদীর তীরস্থিত পারাগ্রামের এ অংশে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ফেলা হয় নিয়মিত। এর ফলে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও গ্রামবাসীর জীবনযাপন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। একসময় নদীর ধারের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মাছ কিনে খেতে হতো না। এখন সেসব দিনের ঠাঁই হয়েছে স্মৃতির পাতায়। নদী ধ্বংসের জন্য তারা সবাই ট্যানারির দিকেই আঙুল তুলছেন। তবে বিধু হালদার খানিকটা খুশি। কেননা নদীতে নতুন পানি আসতে শুরু করেছে। তার মনে ক্ষীণ আশা, আরেকটা শুকনা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি ও তার মতো অন্য জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরার সুযোগ পাবেন।

যেভাবে শুরু: ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেয়ার প্রকল্প হাতে নেয়।

অবশেষে ২০১৭ সালে, হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ট্যানারিগুলো ততদিনে বুড়িগঙ্গা নদীকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন যমুনা থেকে ধলেশ্বরী নদীতে প্রবাহিত শাখানদী কালীগঙ্গা নষ্ট হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্যে।

পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্যানারি এস্টেট এখনো নদীকে দূষিত করছে। ট্যানারি এস্টেট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ট্যানারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে অধিদফতর, কিন্তু নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।

জানা গেছে, ২০২০ সালে পরিবেশ দূষণের দায়ে সাভার ট্যানারি এস্টেটের আটটি ট্যানারিকে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদফতর। একই বছর নদীদূষণের দায়ে বিসিককেও ৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করে। গত মার্চে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলে ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করার জন্য সাতটি ট্যানারির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় অধিদফতর।

গত বছরের ২৩ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ট্যানারদের উৎপাদন করা সমস্ত তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য পর্যাপ্ত শোধনাগার না থাকায় হেমায়েতপুরের সাভার ট্যানারি শিল্প এস্টেট বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে।

পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইপিটি) বা সাধারণ বর্জ্য শোধনাগার কার্যকরভাবে পরিচালনাই মূল চাবিকাঠি। সিইটিপি যখন অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ছেড়ে দেয়, তখনই আসল দূষণটা ঘটে।

তিনি বলেন, ‘পানির গুণমান মাপার কিছু প্যারামিটার আছে আমাদের। প্রতি মাসেই আমরা পানি পরীক্ষা করি। আমাদের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী নিষ্কাশিত পানি প্যারামিটারের মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ সিইটিপি যে পানি-বর্জ্য ছাড়ছে, তা নদীর পানিকে দূষিত করছে।’

জহিরুল ইসলাম তালুকদার জানান, সিইটিপির ছাড়া পানির মান যাতে প্যারামিটারের মধ্যে থাকে, সেজন্য বিসিককে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে চলতে এবং সঠিকভাবে সিইপিটি পরিচালনা করতে বলেছে অধিদফতর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সিইটিপি আধুনিক প্রযুক্তিতে স্থাপন করা হয়নি।

তিনি বলেন, ‘বিসিক দাবি করেছে, সাধারণ বর্জ্য শোধনাগারটির প্রতিদিন ২৫ হাজার ঘনমিটার তরল হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শোধনাগারটির প্রতিদিনের তরল বর্জ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রকৃত সক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার ঘনমিটার।’

অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, শোধনাগারটি ৫-৬ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করলে তখন নিঃসরণ-মান পরিবেশের মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে।

পিক সিজনে ৫০ শতাংশ ট্যানারি প্রতিদিন ৩০ হাজার ঘনমিটারের বেশি তরল বর্জ্য উৎপাদন করে। শোধনাগারে বর্জ্য রাখার সময় ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু ট্যানাররা ১২ ঘণ্টা পরই মডিউল থেকে তা সরিয়ে ফেলে বলে জানান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘পানি সম্পূর্ণ পরিশোধন না করে নিষ্কাশন করলে তা শেষ পর্যন্ত নদী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই, এমন একটা শোধনাগারে নতুন তরল রাখার জায়গা করার জন্য তারা এটি করছে।’

শোধনাগারে অনেক কিছুর অভাব আছে। যেমন ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ইউনিটের জন্য একটি প্লান্ট স্থাপন করার কথা ছিল ট্যানারি এস্টেটের। ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ও পুনর্ব্যবহার করার কথাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কোনোটিই হয়নি।

জানা গেছে, বড় কোম্পানিগুলোর জন্য পৃথক বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এটি করলে সিইপিটির ওপর চাপ কমবে। ছোট কোম্পানিগুলো সাধারণ শোধনাগার ব্যবহার করতে পারবে।

তবে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, নিষ্কাশনকৃত পানির গুণগত মানের উন্নতি হচ্ছে। যদিও তা এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি।

এদিকে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা এখন বেশি উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গত বছর জুলাই মাস থেকে একটি কোম্পানি সিইপিটি পরিচালনা করছে।

পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। কোম্পানিটি যেহেতু এটি নিয়ে কাজ করছে, তাই শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘প্রতি ফোঁটা পানি পরিশোধনের পর নদীতে যায়। যদিও এটা ঠিক যে, এটা ১০০ শতাংশ প্যারামিটার পূরণ করছে না। একটি বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। কয়েকটি বড় কোম্পানিরই কেবল নিজস্ব শোধনাগার স্থাপনের আর্থিক সক্ষমতা আছে।’ কয়েকটি বড় কোম্পানি এরইমধ্যে নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বলে জানান সাখাওয়াত।

বিসিক চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান বলেন, সিইটিপিতে নিয়মিত রাসায়নিক ব্যবহার করায় নদীর পানি এখন দূষণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, নদীর পানির রং হালকা বাদামি হলেও পানি ক্ষতিকর নয়। ‘পানি গ্লাসে নিলে খারাপ দেখাবে না।’

বিসিককে পরিবেশ অধিদফতরের জরিমানা করার বিষয়ের জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরিমানার ঘটনার পর অনেক সংস্কার করা হয়েছে। সিইটিপিতে এখন কোনো সমস্যা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মাহবুবর রহমান বলেন, সবকিছু ভালোভাবেই চলছে। সিইটিপি ভালোভাবে কাজ করছে। বছরখানেক আগে চীনা কোম্পানি সিইটিপি হস্তান্তর করেছে। সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তা দেখার জন্য এই মাসে সিইটিপি পরীক্ষা করা হবে বলে জানান তিনি।

বিসিক চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘আমরা এখন কঠিন বর্জ্য পরিশোধন করার পরিকল্পনা করছি। দ্বিতীয় সিইটিপি স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।’

পরিবেশ অধিদফতরের গত মাসের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, অধিদফতর গত মাসের পানির গুণগত মান সম্পর্কে করপোরেশনকে জানায়নি। আমরা প্রতিবেদনটি দেখে তাদের (ট্যানারদের) নির্দেশনা দেব।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ