বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের পাশাপাশি পরিবেশকে দূষিত করতে নতুন করে দৃশ্যমান পরিবহনের কালো ধোঁয়া। মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির রং ঘষে সার্ভিসিং না করেই হুটহাট নামিয়ে দেয়া হচ্ছে সড়কে। এই প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে। পরিবেশ দূষণে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া অনেকাংশে দায়ী। শুধু মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িই নয়, ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া গাড়ির কালো ধোঁয়াও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু, এ আইন অমান্য করেই ঈদ বা ঈদের পরবর্তী সময়ে রাজধানীসহ সারাদেশের সড়ক দাপিয়ে বেড়ায় এসব পরিবহন। আসন্ন ঈদে মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহন সড়কে নামলে পরিবেশকে বিষিয়ে তুলবে এবং এর প্রভাব জনস্বাস্থ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন।
তারা বলছে, এমনিতেই বায়ুদূষণে বাংলাদেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তুলনায় প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে উঠা নামা করছে। নতুন করে পরিবেশকে দূষিত করার হাতিয়ার মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহন সড়কে নামে, তাহলে সামনের দিকে পরিবেশ আরো বেশি দূষিত হবে এবং জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
সমীক্ষা বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশের বাতাসকে বিষিয়ে তুলতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের পাশাপাশি পরিবহনের কালো ধোঁয়া দায়ী। বায়ুদূষণের জন্য ১৫ শতাংশ দায়ই মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়ার।
চিকিৎসকরা বলছেন, কালো ধোঁয়ার সঙ্গে সূক্ষ্ম বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা এবং হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া কালো ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যাহত হয়।বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। যেগুলো থেকে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে এ ধরনের যানবাহন বাড়ছে। ২০২০ সালের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত মোটরযান আছে ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৮টি। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি গাড়ি রয়েছে রাজধানীতে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। সত্তরের দশকে এদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ কোটিতে। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য যানবাহনের সংখ্যাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। যা নির্মল বায়ুকে দূষিত করছে। ইট পোড়ানোর কারণে নির্গত কালো ধোঁয়াও এজন্য কম দায়ী নয়। পাশাপাশি সামনে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে অতি মুনাফার আশায় হুটহাট করেই সড়তে তুলছে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবহন। সেটা বাস হোক কিংবা ট্রাক। দীর্ঘক্ষণ যানজটে সড়কে অবস্থান করার কারণে এসবের ধোঁয়া পরিবেশকে আরো বিষিয়ে তুলবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুর অন্যতম উপাদান অক্সিজেন মানুষ গ্রহণ করে আর কার্বন-ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে। বায়ুতে অধিক অক্সিজেনের জন্য অধিক গাছপালার প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে গাছপালা কেটে উজাড় করায় বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পরিবেশকে দূষিত করতে সব ধরনের দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। গাড়ি, লঞ্চ-স্টিমারের কালো ধোঁয়া, কলকারখানার কালো ধোঁয়া ও বর্জ্য বায়ুকে আরো বেশি দূষিত করছে। এর ফলে একদিকে যেমন দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে এর একটা প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে পরিবেশ দূষিতের ফলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দূষণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ল্যানসেট কমিশনের এক নতুন গবেষণা বলছে, ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ ও সিসার বিষক্রিয়ায় ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ মারা গেছেন। তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মারা গেছেন বায়ুদূষণে। ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে প্রতি ৬ জনে একজন দূষণের কারণে মারা গেছেন। যুদ্ধ, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, যক্ষ্মা বা মাদকের কারণে বার্ষিক বৈশ্বিক মৃত্যুর চেয়ে এ হার বেশি। দূষণের কারণে মৃত্যুর হার গত ২ দশকে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণের যে উৎসগুলো রয়েছে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত গবেষণায় দেখা যায়, বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের ১২ থেকে ১৫ ভাগ পরিবহন থেকে আসে এবং এগুলো কালো ধোঁয়া, ব্ল্যাক কার্বন। ২০২০ সালে বিআরটিএ ও পরিবেশ অধিদফতরে পর্যবেক্ষণে পরিবেশ অধিদফতর একটি রিপোর্ট তৈরি করে। সেখানে দেখা যায় ঢাকা শহরে যে পরিমাণ যানবাহন রয়েছে তার এক তৃতীয়াংশই ফিটনেসবিহীন। অর্থাৎ ঢাকা শহরে ১০-১৫ লাখ যানবাহন চলাচল করে। এর এক তৃতীয়াংশ মানে ৫ লাখের কাছাকাছি।
তিনি বলেন, দেশব্যাপী মোট ৪০ থেকে ৪৫ লাখ গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই চলাচল করে ১০ থেকে ১৫ লাখ। কিছু গাড়ি রয়েছে যেগুলো এককভাবেই সড়কে কালো ধোঁয়া দিয়ে একেবারে অন্ধাকার করে ফেলে এবং এটি চোখের সামনেই খোদ ঢাকা শহরেই দৃশ্যমান। যদি ঢাকা শহরেই এমন অবস্থা হয় তাহলে বাইরে কি অবস্থা হবে সেটা বোঝাই যায়। যেগুলো গাড়ি ঢাকা শহরে চলাচল করতে পারে না সেগুলো গাড়ি ঢাকার বাইরে চলাচল করে। বায়ুদূষণ যেহেতু কোনো বাউন্ডারি মানে না, সেহেতু যেখানেই বায়ুদূষণ করুক না কেন এর প্রভাব বাতাসের মাধ্যমে সব খানেই প্রভাব পড়বে।
তিনি আরো বলেন, ঈদকে সামনে রেখে পরিবহনের চাপ কমাতে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সড়কে উঠতে পারে। কেননা, আমরা প্রায়ই দেখি ঈদ আসলেই মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রং করে বাহ্যিক দিক ভালো করে সড়কে নেমে পড়ে। কিন্তু, দুর্ঘটনা ঘটে তো ইঞ্জিন সার্ভিসিং আরো যে সার্ভিস করার দরকার সেগুলো না করার কারণে। গাড়ির ফিটনেস আছে কিনা, পরিবেশ দূষণ করছে কিনা এটি দেখাভাল করার জন্য এখতিয়ার পরিবেশ অধিদফতর, বিআরটিএ-এর এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনই যেন গাড়িগুলো সড়কে নামতে না পারে তার সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ