ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লোভের বলি অটোচালক

প্রকাশনার সময়: ১৬ জুন ২০২২, ১১:৫৬

গত ২৮ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বামন খাল থেকে মো. জাবেদ হোসেন নামে এক অটোরিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে আজো উদ্ধার হয়নি জাবেদের অটোরিকশাটি। এ ঘটনার পর গত ৬ জুন গাজীপুরের শ্রীপুরে দুখু মিয়া নামে এক কিশোর অটোরিকশাচালককে গলা কেটে হত্যার পর অটোরিকশা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও অটোরিকশাটি উদ্ধার করেছে। শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, লাইসেন্স ও নাম্বারপ্লেট না থাকার কারণে একের পর এক খুন ও ছিনতাইয়ে শিকার হচ্ছেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। এরপর খুব সহজেই এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার রং পরিবর্তন করে তা আবার রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এসব ঘটনায় খুনি ধরা পড়লেও কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সম্প্রতি এমন একাধিক খুনের ঘটনার তদন্তে মাঠে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গত ৭ বছরে এ ধরনের ৯১টি খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সেখানে দেখা গেছে, প্রতিটি খুনের ঘটনাই ঘটেছে অটোচালকদের লোভ ও সরলতার কারণে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে খুনিরা ভুক্তভোগীর পূর্ব পরিচিত।

সূত্রমতে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই ও খুনের ঘটনার ৯১টি মামলা রয়েছে পিবিআইয়ের হাতে। এর মধ্যে ১০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। চার্জশিট দেয়া হয়েছে ৩২টি মামলার। বাকি ৪৯টি মামলা তদন্তাধীন। ২০১৫ সাল থেকে এ ধরনের যান ছিনতাইয়ে খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করলেও গত কয়েক বছরে তা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০১৮ সালে এ ধরনের ঘটনায় ১২টি, ২০১৯ সালে ১৯টি, ২০২০ সালে ২৪টি এবং ২০২১ সালে ২৪টি। ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ৪টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব তারা হাতে পেয়েছে। শুধু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইয়ে সম্প্রতি বছরগুলোতে যে সংখ্যক খুনের ঘটনা ঘটেছে, অন্য কোনো একক বিষয়ে এত বিপুলসংখ্যক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সম্প্রতি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক খুনের ঘটনা বেড়ে গেলেও ধারাবাহিক অভিযানে খুনিরা ধরা পড়ছে। তারপরও ঘটনা ঘটছে। সাধারণত এসব যানবাহনের কোনো লাইসেন্স না থাকার কারণে দ্রুতই তা গায়েব করা ফেলা সম্ভব হয়। রং পরিবর্তন করে অন্য কেউ ব্যবহার করলেও সহজে ধরা সম্ভব হয় না। সম্প্রতি এ ধরনের অনেক ক্লুলেস মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পিবিআই। আরো কিছু মামলা তদন্তনাধীন রয়েছে। সেগুলোও দ্রুতই শেষ করে ফেলা সম্ভব হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খুনিরা ভিকটিমের পূর্বপরিচিত। এক্ষেত্রে চালকদের আরো বেশি সাবধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, বেশি ভাড়ার আসায় আবার অনেক সময় সরলতায় অনেক সময় চালকরা না বুঝেই ভাড়ায় চলে যায়। এরপর নির্জনস্থানে নিয়ে তাকে হত্যার পর অটোরিকশাটি নিয়ে যাচ্ছে খুনিরা। এক্ষেত্রে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে দূরের ভাড়ায় না যাওয়া এবং বেশি রাতে বের না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, শুধু পিবিআই এ ধরনের ৯১টি মামলা তদন্ত করলেও থানা-ডিবি-সিআইডির হাতে রয়েছে শত শত মামলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাইসেন্স না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। বিগত সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও করোনাকালে তা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে চোরাই গাড়ি উদ্ধার হলেও খুনিরা অধরা থেকে যাচ্ছে। এসব দুর্বৃত্ত আবারো একই ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। যা প্রশাসনের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশার ছিনতাইয়ের পর তা বিক্রি করতে জেলাপর্যায়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ছিনতাইকৃত গাড়ি বিভিন্ন ইজিবাইক শো-রুম ও ব্যাটারিচালিত রিকশা রূপান্তরের দোকানে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর সেখানে রং পরিবর্তন করে অন্য খরিদ্দারের কাছে খুব সহজেই বিক্রি করে দেয়া হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রমাণ লোপাট করতে ব্যাটারিগুলো আলাদা বিক্রি করে দিয়ে চেসিস ফেলে দেয়া হয় অন্যত্র।

পিবিআই সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ নয়া শতাব্দীকে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, চালককে খুনের পর ছিনতাইকৃত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় তারা বিক্রি করেন। এজন্য বিভিন্ন শো-রুমের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শুধু ব্যাটারিগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়। এক একটি ব্যাটারি বিক্রি হয় মাত্র ২ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। একটি ইজিবাইক ও রিকশায় ৮টি করে ব্যাটারি থাকে। এসব ব্যাটারি কেনার পর তা থেকে সিসা বের করে বিভিন্ন কারখানায় বিক্রি করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ জন্য উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক অনেক ব্যাটারি গালানোর কারখানাও গড়ে উঠেছে।

জানা গেছে, ব্যাটারি ও ইজিবাইকের লোভে পেশাদার খুনিদের একটি অংশ চালককে খুন করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভয়াবহ এ পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় ২০২১ সালের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এর কারণ হিসেবে এসব যানে অধিক দুর্ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে চালক ও শ্রমিক সংগঠনের নানামুখী আন্দোলনের মুখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গাড়ি চুরি ও ছিনতাই প্রতিরোধ টিমের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নয়া শতাব্দীকে জানান, ব্যাটারিচালিক রিকশা, অটোরিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইয়ে চালককে খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর প্রতিটি এলাকাতেই ভিন্ন ভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ তিনটি দলে বিভক্ত। প্রথম দলের সদস্যরা একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালককে টার্গেট করে তার সব খোঁজ-খবর নেয়। তার বাসা-বাড়ি ও গাড়ির গ্যারেজের অবস্থান রেকি করে। সংগ্রহ করে চালকের মোবাইল ফোন নম্বর। এসব তারা দ্বিতীয় দলকে বুঝিয়ে দেয়। এ দলের সদস্যরা গাড়ির গ্যারেজের আশপাশে অবস্থান নেয়। দিনভর গাড়ি চালিয়ে চালক রাতে গাড়ি গ্যারেজে জমা দিতে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীরা যাত্রীবেশে গাড়িতে চড়ে এবং লোভনীয় ভাড়া দেয়ার কথা বলে নির্জন এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে চালকের গলায় গামছা পেছিয়ে শ্বাসরোধ করে কিংবা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। লাশ রাস্তার পাশে ফেলে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। গাড়িটি তৃতীয় দলের হাতে পৌঁছে দিয়ে তারা তাদের কাজ শেষ করে। পরবর্তীতে তৃতীয় দলের সদস্যরা গাড়ির রংসহ আনুষঙ্গিক কিছু সাজ-সরঞ্জাম পরিবর্তন করে তা বিক্রি করে দেয়। গাড়ি বিক্রির অর্ধেক টাকা নেয় খুনিরা। বাকি টাকা অন্যরা সমানভাবে ভাগ করে নেয়। প্রতিটি ঘটনা সফলভাবে শেষ হওয়ার পরপরই তারা দ্বিতীয় মিশন শুরু করে।

সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরের বাইরে উত্তরবঙ্গে বেশি ইজিবাইকের চলাচল। এছাড়া এখন গ্রামে প্যাডেলচালিত রিকশার বদলে সবার হাতেই ব্যাটারিচালিত রিকশা। এসব বাহনের চালক রাতে বাড়ি ফেরার সময় দুর্বৃত্তরা লোভনীয় ভাড়ায় তাদের দূরে কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে চালক রাজি হলেই নির্জন কোনো স্থানে নিয়ে তাকে খুন করে বাহন ছিনতাই করে। এরপর চালকবেশে দুর্বৃত্তরা বাহন নিয়ে চলে যায়। গ্রামের পাশাপাশি রাজধানীর উপকণ্ঠগুলোতেই ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট রয়েছে। বিশেষ করে গাজীপুর, টঙ্গী, সাভার, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ৩০০ ফিট, তুরাগ, বাউনিয়া ও আশুলিয়া অন্যতম। এসব এলাকা থেকে ছিনতাইকৃত বাহন পাঠিয়ে দেয়া হয় মফস্বল এলাকায়। আবার মফস্বল এলাকা থেকে ছিনতাইকৃত বাহন পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানীর উপকণ্ঠ এলাকাতে।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ