সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি ঘটনায় একটি কনটেইনারকে ঘিরে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অগ্নিকাণ্ডের পর সর্বপ্রথম হাইড্রোজেন পার অক্সাইডবোঝাই ওই কনটেইনারটি বিস্ফোরিত হয়। এরপর আগুন দ্রুত আশপাশের কনটেইনারে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটতে থাকে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনা। সন্দেহের কেন্দ্রে থাকা ওই কনটেইনারটির পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য রফতানিকারকেরও সন্ধান করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল মঙ্গলবার সিআইডির বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের একটি টিম ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। সেগুলো পরীক্ষার পর কেমিক্যালের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানতে চাইলে বিএম কনটেইনার ডিপোর জেনারেল ম্যানেজার মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে ডিপোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কন্টেইনারের মধ্যে মাত্র একটি কন্টেইনার বিস্ফোরণ হওয়া রহস্যজনক। বিষয়টি নাশকতা কিনা তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের কার্গো কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে জড়িত দেশের সব বেসরকারি এই কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) কাস্টমসের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিসও রয়েছে ডিপোর ভেতরে। তারা ডিপোতে আমদানি-রফতানির কাজে সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনুমতি ব্যতীত কন্টেইনার তো দূরের কথা এক কেজি পণ্যও ডিপোতে প্রবেশ কিংবা বের করা অসম্ভব। এমনকি আমদানিকৃত বা রফতানিযোগ্য কোনো কন্টেইনার লক-আনলক করতেও তাদের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সুতরাং ওই কনটেইনারে কী ছিল তারাই বলতে পারবে।
জানা গেছে, এ ঘটনায় হতাহতদের বড় একটি অংশই ডিপোর বাইরের মানুষ, সাধারণ পথচারী। নিয়মানুযায়ী কাস্টম পাস ছাড়া কনটেইনারবোঝাই লরি, ট্রাক, প্রাইমমুভার ঢোকার সুযোগ নেই ডিপোতে। অথচ কড়া নিরাপত্তা এড়িয়ে সিকিউরিটি পাস ছাড়া সাধারণ মানুষ কীভাবে ডিপোতে প্রবেশ করেছে— সেই প্রশ্নের যৌক্তিক কোনো উত্তর নেই কারো কাছেই। এ কারণে রহস্যের চোরাবালিতে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘটনার পর গঠিত বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত কমিটি সদস্যরাও। তদন্ত দলে কয়েক সদস্য বিএম কনটেইনার ডিপোর বিস্ফোরণকে পরিকল্পিত নাশকতা বলে ধারণা করছেন।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রফতানি হচ্ছে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে থাকা আল রাজী কেমিক্যালের ক্রেতা পাকিস্তানের। এ কারণে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জারভর্তি পাকিস্তানে রফতানির জন্য অপেক্ষায় থাকা কনটেইনারগুলোর ক্রেতা সম্পর্কেও খোঁজ নিচ্ছেন সিআইডি।
সূত্রমতে, আইসিডি লোডিং শেডের পাশে মৃদু অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় শনিবার রাত সোয়া ৯টায়। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের দেড় ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয় ডিপোর শ্রমিকদের আগুন নেভানোর প্রচেষ্টায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা শ্রমিকদের অনেকেই নিশ্চিন্তে নিজ নিজ কাজে ফিরে যান। আর তখনই কনটেইনারে বিস্ফোরণের মতো বড় বিপত্তির সূচনা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের উপস্থিতিতেই কনটেইনার বিস্ফোরণ হওয়ার বিষয়টি সাদা চোখে দুর্ঘটনা মনে হলেও, নাশকতাকারীদের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো শুরু করার ২৭ মিনিট পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে ডিপোর প্রথম কনটেইনারটি। যদিও ডিপোটিতে আগুন লাগার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আহত শ্রমিকরা জানান, পানির সংযোগ স্থাপনে লাগে আধা ঘণ্টার বেশি সময়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ক্রেন অপারেটর রিপন বলেন, শুরুতে আগুন লাগা কনটেইনারটি টুয়াইস হাইটে (একটির ওপর অন্যটি রাখা) ছিল। পার্শ্ববর্তী লাইনে ফোর হাইটে থাকা একটি কনটেইনার সরানোর চেষ্টাকালেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। আগুনের কারণে অপারেটরদের কেউই অতিরিক্ত হিটে উত্তপ্ত আশপাশের কনটেইনার সরাতে রাজি হচ্ছিল না। ডিপোতে কর্মরত ম্যানেজার খালেকের পীড়াপীড়িতে অপারেটররা কনটেইনার সরানোর কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথম বিস্ফোরণে ডিপোতে কর্মরত তিন অপারেটর ঘটনাস্থলেই মারা যান। এক কর্মকর্তার বাম হাত উড়ে যায়। মারাত্মক জখম হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। প্রথম বিস্ফোরণে দুই এলএফডি অপারেটরের মৃত্যু হয়। আইসিডি ম্যানেজার আজিজও মারাত্মকভাবে জখম হন। চারজন ফায়ার ফাইটারও মারা যান স্পটে।
তার বর্ণনা মতে, বিস্ফোরণের জন্য অপ্রস্তুত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পর্যাপ্ত ‘নিরাপত্তা পোশাক’ ছাড়াই শুরু থেকে কনটেইনারের কাছাকাছি গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন। একই সঙ্গে আগুনের সূত্রপাত হওয়া কনটেইনারের বিপজ্জনক দূরত্বে উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন ঘটনাস্থলে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিল, বিস্ফোরণ হওয়া কনটেইনারের কাছাকাছি দূরত্বে অন্তত শ’খানেক উৎসুক শ্রমিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মোবাইল ফোনে আগুনের ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলেন। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভও করছিলেন। ঘটনার সময় ধারণ করা পাঁচটি মোবাইল ফোনের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগুনের নিরাপদ দূরত্বে না থেকেই পানি ছিটানোর কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে অবস্থিত ন্যাশনাল ফায়ার চিফ কাউন্সিলে (NFCC) কর্মরত বিশেষজ্ঞ অমিতাভ কাউসার জানান, অগ্নি ত্রিভুজ (Fire Triangle) বলে একটি বিষয়কে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। অগ্নি ত্রিভুজে আগুনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় তিনটি বিষয়কে মাথায় রাখার কথা বলা হয়। ইগনিশন, জ্বালানি এবং অক্সিজেন। যে কোনো অগ্নিঝুঁকি মূল্যায়নের প্রথম ধাপ হলো আগুনের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা। বিএম ডিপোর অগ্নি বিস্ফোরণে দৃশ্যত হাইড্রোজেন পার অক্সাইডকে ফায়ার ট্রায়াঙ্গল হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে ঘটনার পরে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, জৈব রাসায়নিকের উপস্থিতি, কনটেইনারের উপরিভাগ ও ভেতরের আস্তরনে জৈব রাসায়নিকের মিশ্রণের মতো সম্ভাব্য কিছু যোগসুত্রকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এই কারণে কনটেইনারের আগুন অতিরিক্ত তাপ-চাপ বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। আগুনের সূত্রপাত হওয়া কনটেইনারের খুব কাছাকাছি থেকে পানি স্প্রে করার কৌশলটিকে অপেশাদার আচরণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থার এই ফায়ার সেফটি বিশেষজ্ঞ। বিপজ্জনক দূরত্ব শ্রমিক, ড্রাইভার, উৎসুক মানুষের অবস্থান করাটাও আকস্মিক বিস্ফোরণে ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়েছে বলে অভিমত তার। এছাড়া অগ্নিনির্বাপণ নিরাপত্তা কোডের আন্তর্জাতিক ম্যানুয়াল অনুসরণ করেননি নির্বাপণ কাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। হ্যাজার্ড সংকেত না দেয়া, উৎসুক মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে না নেয়াটা মারাত্মক ভুল ছিল। অভিযানের শুরুতে আগুনের কারণে ঘটনাস্থলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি সম্পর্কে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কনটেইনার ইয়ার্ডের তাপমাত্রা সম্পর্কে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে না বিএম ডিপো। বিস্ফোরণের দিন তাপমাত্রার চাপ সম্পর্কে কোনো ধারণাই দিতে পারেননি চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ। হ্যাজার্ড বিশ্লেষকরা বলছেন, কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপের সৃষ্টি হওয়ার কথা। তবে আশপাশে মানুষের উপস্থিতি দেখে অনুমান করা যায় সেই তাপমাত্রা (ধারাবাহিক বিস্ফোরণ উপযোগী) অস্বাভাবিক রেখা অতিক্রম করেনি। যে কারণে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরণের মতো বিধ্বংসী আচরণ করতে পারে।
হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ঝুঁকি সম্পর্কে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিজ্ঞানী ড. আবু আলী ইবনে সিনা বলেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, বিশুদ্ধ বা মিশ্রিত আকারে, বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রায় ৭০% ঘনত্বের ওপরে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাষ্প ছেড়ে দিতে পারে— যা স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ৭০ @°C (১৫৮ °F) এর ওপরে গেলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড মূলত ডিকম্পোজ হয়ে অক্সিজেন তৈরি হয়। এই এইচটুওটু (H2O2) মূলত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। এটাকে ভেঙে অক্সিজেন রিলিজ হয় আর পানি তৈরি হয়। ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের জারে। সে কারণে কনটেইনারে রাখা কেমিক্যাল ভর্তি জার উত্তাপে অক্সিজেন রিলিজ হয়ে ব্লাস্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। জারের গায়ে লাগানো স্টিকার অনুযায়ী ৫০% ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড।
সাইন্স ডাইরেক্টের তথ্যানুযায়ী হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের স্ফুটনাঙ্ক ১৫০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা পানির চেয়েও ৫০ ডিগ্রি বেশি। যে তাপমাত্রায় কোনো তরল পদার্থ বুদ্বুদসহ ফুটতে থাকে, তাকে সেই তরল পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক বলে। অতিরিক্ত তাপ চাপ (টেম্পারেচার প্রেসার), পানি ছিটানোর ফলে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন স্থানীয় কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, বিএম ডিপোতে বিস্ফোরিত কনটেইনারে কোনো ধরনের জৈব রাসায়নিকের উপস্থিতি (organic peroxide) ছিল কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিআইডির একটি সূত্র। সূত্রটি জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘ চার বছর ধরে পড়ে থাকা ছয়শ’ ৩০টি হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জার কখনোই অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা সৃষ্টি করেনি। অর্গানিক পার অক্সাইডের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে— বিশেষজ্ঞের এমন মতামত জানার পরপরই বন্দরের কনটেইনার শেড থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে জারগুলো। বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে ঘটনা তদন্তে নাশকতার শঙ্কা থেকেই অর্গানিক কেমিক্যালের সম্ভাব্য সূত্র খুঁজছে সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিম।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, নাশকতার ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনায় ডিপোর বিভিন্ন কনটেইনারে জৈব রাসায়নিকের মতো কেমিক্যাল ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি মোটেই কষ্টকর নয়। বিশেষ করে, আগুনের সূত্রপাতের পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার কারণে অর্গানিক অক্সাইডের মতো কেমিক্যাল ছড়ানোর কাজটি করা খুব কঠিন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে কনটেইনার ডিপোগুলোর নিরাপত্তা জোরদার ও তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা জরুরি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বন্দরসংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কনটেইনার পৃথকীকরণ, ‘আইএমডিজি’ নীতিমালা পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের কথা ভাবাটা কতখানি জরুরি সেই বার্তা দিয়েছে বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ