বাংলাদেশে উন্নয়নে দৃশ্যচিত্রের উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে পবিবেশকে সুরক্ষা রাখার সক্ষমতা। প্রতি বছর উন্নয়নের জন্য সব খাতে বাজেট বাড়ানো হলেও বাজেট বাড়ে না পরিবেশ খাতে। অথচ দেশের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পরিবেশ। প্রতি বছর পরিবেশ দূষণের কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের কারণেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিপূর্ণ থাকে দেশ। ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই) অনুযায়ী, বিশ্বের চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে অর্থাৎ ১৮০তম। অথচ এ অবস্থায়ও বিগত বছরগুলোতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কমেছে। প্রতি বছর বাজেটে পরিবেশকে গুরুত্বে না দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন— দেশে এখনো পরিবেশকে মনে করা হয় ক্রসকাটিং বিষয়। কিন্তু সারা বিশ্বে পরিবেশ এখন একটা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে চিন্তা করার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, সেটি দেখা যেতে পারত বাজেট থেকে। বিগত বছরগুলোয় পরিবেশের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, তা অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটের তুলনায় খুবই কম। পরিবেশের ক্ষতির কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ নেতিবাচক প্রভাব আছে সেটা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে আরো সক্ষমতা সম্পন্ন করা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শও দেন তারা। বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচটি অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়লেও বরাদ্দ খুব একটা বাড়েনি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। সবশেষ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) চেয়ে ২৫ কোটি টাকা কম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পেয়েছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) এ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) তা ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা করা হয়।
সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা যেন পরিবেশের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা ও উৎপাদনে এ বরাদ্দের ৩০ ভাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি সবুজায়ন বাড়ানোর জন্য সারাদেশে ১০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা যেতে পারে। পরিবেশ খাতের উন্নয়নের অন্যতম শর্তই হচ্ছে পর্যাপ্ত গবেষণাগার। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারব ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারব।
কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, তা থেকে উত্তরণ ও আগাম ফসল প্রস্তুতিতে বরাদ্দের অর্থ প্রয়োজন পড়বে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সারিতে অবস্থান। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পায়ন বাড়লেও ছোট হয়ে আসছে নদ-নদী ও খাল-বিল। উজাড় হচ্ছে বনভূমি, দূষিত হচ্ছে বাতাস। বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় প্রথম থেকে পঞ্চম সারিতে উঠানামা করছে। আবার কোনো সময় হুট করেই শীর্ষে চলে আসে। যা নগরীবাসীর জন্য স্বাস্থ্যের ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করেছে। আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, টেকসই পরিবেশ-বান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার বিষয়গুলো সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োগ করা না গেলে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মহলে।
আবদুল্লাহ আল নাঈম। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ নিয়ে পড়াশোনা করেন। বিগত কয়েক বছর ধরে পরিবেশ নিয়ে কাজও করছেন একটি পরিবেশ সংগঠনে। পরিবেশে বাজেট নিয়ে তার সঙ্গে কথা বললে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা এমনি একটি কাজ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক কিছু। এটি সুরক্ষায় সর্বদায় আমাদের সবাইকে সচেতন ও সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পরিবেশে যে বাজেট আমরা লক্ষ করছি সেটা পরিবেশের ক্ষেত্রে সেটা সামান্য। এটা দিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় শতভাগ মনিটরিং করা হয়তো সম্ভব হয় না। আমরা চাই, সরকার এ বিষয়ে আরো জোরালোভাবে নজর দিক। এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ দূষণে সব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী নয়া শতাব্দীকে বলেন, পরিবেশের বাজেট অবশ্যই বাড়ানো উচিত। বিগত সময়ে যখন বাজেট কম ছিল তখন পরিবেশে বাজেট হিসেবে ঠিক ছিল। মাঝেও বাজেট বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমানে যে বাজেট রয়েছে তার থেকে বাজেট বাড়লে মাঠ পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষায় মনিটরিংটা একটু বৃদ্ধি পাবে। আমরা সব সময়ই বলব, পরিবেশ রক্ষায় সর্বদায় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের দেশে যখন বাজেটের পরিমাণ ১ লাখ ছিল তখন পরিবেশে বাজেটের পরিমাণ ভালো ছিল। এখন আবার সেটা লক্ষ করা যায় না। দিন দিন বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু পরিবেশের বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে না। সবশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ২০২১-২০২২ বাজেট কমেছে ২৫ কোটি। পরিবেশে বাজেট বাড়ানো খুবই জরুরি। পরিবেশের ভেতরে অন্যান্য জিনিসগুলো এমনভাবে দেয়া হচ্ছে যেগুলো আসলে পরিবেশের না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অবকাঠামোর বরাদ্দকে পরিবেশে দেয়া হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, যথাযথভাবে যেন পরিবেশের জন্য টেকসই বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ