ফৌজদারি অপরাধসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে ব্যবহার হচ্ছে জ্যামার। বিশেষ করে বাসা-বাড়িতে ডাকাতি ও গোপন বৈঠকের আগে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা এই যন্ত্রটি বসানোর প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
নিজেদের অবস্থান আড়াল করেতেই এই পরিকল্পনা এঁটেছে অপরাধারীরা। এতে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত ও তাদের আইনের আওতায় আনতে বেগে পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। অথচ সাধারণ মানুষের জন্য দেশে জ্যামার আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। তারপরেও নজরদারির অভাবে কৌশলে তা আমদানি করে অপরাধীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জ্যামার বিক্রির সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ২৪টি জ্যামার ও জ্যামার এন্টেনা। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা র্যাবের কাছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য স্বীকার করে। তাদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে আরো ১৫ থেকে ২০ জনের সন্ধানে নেমেছে র্যাবের গোয়েন্দারা।
এ বিষয়ে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, শনিবার গ্রেফতার দুইজনের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, যন্ত্রটি অপরাধীদের হাতে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেই সূত্র ধরে আরো একাধিক ব্যক্তির ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের গ্রেফতার করা হবে। জানা গেছে, সাধারণ মানুষের জন্য দেশে জ্যামার আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। এরপরও নজরদারির অভাবে কৌশলে আমদানি হচ্ছে এই ডিভাইস। বিক্রি করা হচ্ছে চড়া মূল্যে। সম্প্রতি জ্যামার বিক্রি চক্রের কিছু সদস্য বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এর ব্যবহারকারীরা। দেশে জ্যামার ব্যবহারকারীর সঠিক হিসাবও জানা নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
পুলিশের একটি সূত্রমতে, জ্যামার ব্যহারকারীদের একটি বড় অংশ পয়সাওয়ালারা। তারা নিজেদের এলাকা নিরাপদ রাখতে অনেক সময় যন্ত্রটি ব্যবহার করে থাকেন। এ কারণে পুলিশের ইচ্ছা থাকলেও ওইসব ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এর ফলে অনেক সময় জ্যামার বসানো এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আবার অনেক সময় অপরাধীরা নিজেরাই জ্যামার ব্যবহার করে থাকেন। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আসামি গ্রেফতারে মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর বেশি নির্ভরশীল। বিভিন্ন সময়ে মোবাইলের সূত্র ধরেই আসামিরা গ্রেফতার হয়ে থাকে। এ কারণে দাগি আসামিরাও এখন মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে জ্যামারের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। বিশেষ করে বড় ধরনের অপকর্ম শেষে নিজেকে আড়াল করে তারা নিজ এলাকায় জ্যামার বসিয়ে দেন। বাজারে পাওয়া জ্যামারগুলো ৫০ মিটারের মধ্যে সব ধরনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দাবি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, জ্যামার আমদানি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। তা না হলে অপরাধকাণ্ডে এর ব্যবহার আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। একইসঙ্গে নিয়মিত মনিটরিংও চালানো উচিত। এজন্য আলাদা কমিটি থাকা জরুরি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মশিউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, জ্যামার ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ পয়সাওয়ালা। তারা নিজেদের এলাকা নিরাপদ রাখতে অনেক সময় জ্যামার ব্যবহার করেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন আশপাশের বাসিন্দারা। এজন্য বিটিআরসির নীতিমালা থাকা জরুরি। তবে যন্ত্রটি দেশে নিষিদ্ধ। এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারকারীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অপরাধীদের হাতে যেন যন্ত্রটি পৌঁছাতে না পারে সেজন্য পুলিশি তৎপরতা রয়েছে।
জানা গেছে, জ্যামারের মতো প্রযুক্তি সাধারণত সরকারি নিরাপত্তামূলক কাজে আমদানি ও ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে কারাগার ও ভিআইপি মুভমেন্টে যন্ত্রটি ব্যবহার করে থাকেন সংশ্লিষ্টরা। বায়তুল মোকাররম ও স্টেডিয়াম মার্কেটে এই প্রযুক্তি বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই। অসাধু ব্যবসায়ী বৈধ যন্ত্রপাতির আড়ালে এগুলো আমদানি ও বিক্রি করছেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারের কারণে নেটওয়ার্কনির্ভর অভিযানিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকি কোনো এলাকায় নাশকতা করতে চাইলে সন্ত্রাসীরা জ্যামার ব্যবহার করে সেই এলাকার টেলিযোগাযোগ ব্লক (অচল) করে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল থেকে কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নাশকতার বিষয়ে তথ্য দিতে না পারে। আবার অনেক সময় কোনো বাসা-বাড়িতে ডাকাতির উদ্দেশ্যেও জ্যামার ব্যবহারের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি উত্তরখানের একটি বাসায় ডাকাতি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ওই এলাকায় মোবাইল ব্যবহারকারীর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি গোয়েন্দাদের প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে মিরপুরের একটি গ্রিল কাটা চুরির মামলার ক্ষেত্রেও। পুলিশের ধারণা, এই দুটি ঘটনাতে জ্যামার বসানো হয়েছিল ওই এলাকায় দুটিতে। যদিও ওইসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে অপরাধী শনাক্ত করেছে পুলিশ। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। রাজধানীর বনানী, নিকুঞ্জ-১, গুলশান বারিধারা, মহাখালী, ও ধানমণ্ডিতে এসব অবৈধ প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে বলেও তিনি দাবি করেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর উত্তরায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সদস্যকে জ্যামারসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়াতে ওই জঙ্গিরা জ্যামার ব্যবহার করছিল বলে তদন্তে উঠে আসে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে রাজধানীর কাকরাইলে তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্দেশ্যে জ্যামার বসানোর তথ্য পায় পুলিশ। এলিফ্যান্ট রোডের একটি দোকান থেকে কেনা জ্যামার দুটি বসানো হয় মারকাজের দক্ষিণ পাশের ভবনের তৃতীয় তলার দুটি কক্ষে। বড় ধরনের ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার উদ্দেশ্যে এসব জ্যামার বসানো হয়েছিল বলে দাবি পুলিশের।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ