ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তিন কৌশলে অর্থ পাচার

প্রকাশনার সময়: ১৬ মে ২০২২, ১৫:২৮ | আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ১৫:৩৬

দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে ভারতে গ্রেফতার হওয়া পি কে হালদারকে অচিরেই দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। কিন্তু পিকে হালদারের মতো আরো যারা দেশের লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তাদের আইনের আওতায় এনে গ্রেফতারের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায় বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) সারা বিশ্বে অবৈধ অর্থ লেনদেনের ওপর গবেষণা করে থাকে। সংস্থাটি বিভিন্ন সময় সংশয়পূর্ণ অর্থ লেনদেনের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। পণ্যের মূল্য ঘোষণায় ফাঁক রেখে ছয় বছরের বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার ‘পাচারের’ হিসাব এসেছে সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্ট সময়কালের হার অনুযায়ী ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।

জিএফআই’এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক দশকে বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৩৪ দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে এক দশমিক ছয় ট্রিলিয়ন বা একলাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এভাবে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে চীন থেকে। এরপরই আছে পোল্যান্ড, ভারত, রাশিয়া ও মালয়েশিয়া। এই ১০ বছরে ১৩৪টি দেশের দেয়া যেসব তথ্য জাতিসংঘের ডেটাবেজে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে জিএফআই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ডেটা পাওয়া যায়নি।

জিএফআই যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, ২০০৯ সালের পর থেকে এভাবে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বেড়েছে। দুটি নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের তথ্য মিলিয়ে দেখে এই গরমিল বের করে জিএফআই। আমদানি-রফতানিকারকরা পণ্য আমদানি-রফতানির সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম-বেশি দেখানোর মাধ্যমে অর্থ পাচার করেন। অর্থাৎ যে দামের পণ্য তিনি কিনছেন, তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) বিদেশে পাচার করছেন। একইভাবে রফতানি পণ্যের দাম কম (আন্ডার ইনভয়েসিং) দেখিয়েও ফাঁকি দেয়া হয়।

জিএফআই বলছে, বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৮২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার এভাবে বেরিয়ে যায়, যা মোট বাণিজ্যের ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিশ্বের উন্নত ৩৬টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ৩৫৬ দশমিক ৮০ লাখ ডলার, যা এসব দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৬টি উন্নত অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাণিজ্যে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের গরমিল দেখা গেছে।

অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া কতটা কঠিন

কিছুদিন আগে কারামুক্ত যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগও ছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডির দায়ের করা সে মামলায় বলা হয়েছে, যুবলীগের সাবেক এই নেতা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছেন। তিনি ছাড়াও বাংলাদেশে বর্তমানে ডজনখানেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা চলছে, যেখানে দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পৃক্ত আছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন যে, পাচারের তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন। আরো কঠিন হলো সেই তথ্যের সপক্ষে প্রমাণ জোগাড় করা। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

খুরশিদ আলম বলেন, মিউচুয়াল লিগাল অ্যাসিসট্যান্সের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে সহায়তা চাইতে পারি। আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য আরেকটি দেশের কাছে এ সংক্রান্ত সহায়তা চাওয়া হয়। তখন সংশ্লিষ্ট দেশ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তথ্য দেয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে সে তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আসে। তারপর সেই তথ্য আমরা আদালতে দাখিল করি।

যেভাবে পাচার হয় অর্থ : বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি বড় উপায় হচ্ছে বাণিজ্য কারসাজি। আরেকটি উপায় হচ্ছে হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে থেকে যায়। একইভাবে রফতানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না।

অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। অর্থাৎ বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, এগুলো ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং হিসেবে পরিচিত। তিনি আরো বলেন, টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। খুব প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোনো একটি পণ্যের দাম যত হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেয়া হয়।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সরকারের আইনানুযায়ী বিদেশে টাকা পাঠানো এত সহজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো অসম্ভব। বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের সময় এক ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া এডুকেশন এবং ট্রিটমেন্টের জন্য শর্তসাপেক্ষে অর্থ নেয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেয়া নিষিদ্ধ।

ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মকর্তা যা-ই বলুন না কেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের আইন যতই কঠোর হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, অর্থ পাচার থেমে নেই। এ সেক্টরে পাচারকারীরা নিত্য-নতুন কৌশলও খুঁজে বের করছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশে হয়তো বাড়ি ও সম্পদ ক্রয় করা হচ্ছে নতুবা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কানাডার মন্ট্রিলে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাসরত নাসিম সরকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বহু টাকাওয়ালা মানুষ কানাডায় আসছেন। তাদের টাকার কোনো সমস্যা নেই। বাড়ি কিনছেন। গাড়ি কিনছেন। আমরাও এখানে বাড়ি কিনতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংক লোন নিতে হয়। বাংলাদেশ থেকে যারা আসছেন তারা নগদ টাকা দিয়ে, অনেক ঘটনায়, প্রচলিত দামের চাইতে বেশি দামে বাড়ি কিনে নিচ্ছেন। কানাডার আইন অনেক শক্ত বলা হলেও বাস্তবতা হলো, কেউ নগদ টাকায় বাড়ি কিনতে চাইলে তার নাগরিকত্ব বা অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। নাসিম বলেন, যারা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না তাদের বাড়ির ক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়।

আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত মোতাহার হোসেন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, অনেক ব্যবসায়ী যে রফতানি করেন সেখান থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশের ব্যাংকে রাখছেন। সেই টাকা বাংলাদেশে আসছে না।

তিনি আরো বলেন, একটি দেশ থেকে টাকা তখনই পাচার হয় যখন সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে মানুষের আস্থা কম থাকে। এখানে বিষয়টি হলো আস্থার। ঠিক আছে, আমি যে কোনোভাবে টাকা কামাই করলাম, এখন এটাকে সেফ রাখতে হবে। এটা হচ্ছে একটা বিষয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এখানে ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ নেই। বাইরে পাঠিয়ে দিলে নিরাপদ। সর্বসাকল্যে বুঝতে হবে এখানকার সিস্টেমের ওপর ওই ব্যক্তির কোনো আস্থা নাই।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালের মাঝামাঝি যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সেখানে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সেসব ব্যাংকে কারা টাকা রেখেছেন সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। শুধু সুইজারল্যান্ডেই নয়, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়ত।

ব্যাংক কর্মকর্তা এবং আইনজীবীরা বলছেন, টাকা পাচার হয়ে গেলে সেটি আবার দেশের ভেতরে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ। সে নজিরও খুব একটা নেই। ২০১২ সালে সিঙ্গাপুর থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের ২১ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছিল।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ