দেশে ডিজিটাল কায়দায় ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব মাদক। ম্যাজিক মাশরুম, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, খাট, এলএসডি, ডিএমটি, ড্যান্ডি, এস্কাফ— এ রকম সব ভয়ংকর মাদকের ছড়াছড়ি এখন উচ্চবিত্ত সমাজে। এরই মধ্যে এসব মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে দেশের কয়েক লাখ তরুণ-তরুণী।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রগুলো জানায়, রাজধানী ঢাকাতে নতুন এসব ভয়ংকর মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে ধনী পরিবারের কয়েক হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। এতে শঙ্কিত অভিভাবক মহল। সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তে করতে গিয়ে আলোচনায় উঠে আসে কুখ্যাত নতুন মাদক এলএসডি। এরপরই একে একে ধরা পড়ে ভয়ংকর নতুন মাদক আইস, ম্যাজিক মাশরুম ডিএমডি নামের মাদক। অনলাইন অর্ডারের পর কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে এসব ভয়ংকর ড্রাগ ঢুকছে বাংলাদেশে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী নৌপথ দিয়ে দেশে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস। কখনো আচার, কাপড়ের প্যাকেট, কখনো চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেটে। টেকনাফে আইসের চালান কয়েক স্থানে মজুদ রাখা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন যানবাহনে করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পৌঁছে দেয়া হয়। আইসের কোনো চালান যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক জব্দ হয় তাহলে কোনো ধরনের পেমেন্ট নেয় না মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে ১৮ বছর বা এর বেশি বয়সি মাদকাসক্ত আছে প্রায় ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার। ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু-কিশোর আছে ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। সম্প্রতি র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এক সংবাদ সম্মেলন জানান, মাদকের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব । এদিকে গত বছর সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত শিশু অধিকারবিষয়ক সংসদীয় ককাস এবং সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্ক্যাস)-এর এক অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। প্রতি বছর মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে শিশু ও নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইয়াবার মতো মাদক এখন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও অবলীলায় গ্রহণ করছে। বিগত ১০ বছরে মাদকাসক্তির কারণে খুন হয়েছেন ২০০ মা-বাবা। ডিএমপি জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপপুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন জানান, গত আট মাসে প্রায় ১৪ হাজার মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় ৯৮২১টি মামলা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মাদকের মধ্যে রয়েছে ভয়ংকর আইস (ক্রিস্টাল মেথ) ৭২৭ গ্রাম ও এলএসডি মাদক ২ গ্রাম ১২ মিগ্রা ও ৪০ পিস। মাদকদ্রব্য নিযন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের প্রধান ও সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান জানান, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ভয়ংকর নতুন মাদক আইসসহ নতুন মাদকের ২০০ কারবারি রয়েছে। এদের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান।
সূত্রগুলো জানায়, মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে সব থমকে গেলেও এসব মাদকের ব্যবসা ছিল রমরমা। লঞ্চ, ট্রেন ও আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও থেমে ছিল না মাদক পরিবহন। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পন্থায় এসব মাদক আনা-নেয়া চলেছে। জরুরি পণ্য পরিবহনের আড়ালে কয়েক ধাপে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে ক্রেতা অর্থাৎ মাদকসেবীদের হাতে। এমনকি ‘হোম ডেলিভারির মাধ্যমে মাদক বিক্রি হতো। গত কয়েক মাসে পুলিশ, র্যাব সহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভয়ংকর নতুন মাদক ম্যাজিক মাশরুম, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, খাট, এলএসডি ও ডিএমটি, ড্যান্ডি, এস্কাফ ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্যের বড় বড় চালান ধরে। কাঁচামালের আড়ালে, পিকআপ ভ্যানের পাটাতনে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের ইঞ্জিনের ভেতরেও এসব মাদক জব্দ করা হয়েছে।
ভয়ংকর নতুন মাদক এলএসডি: গত বছর জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তে নতুন করে আলোচনায় এসেছে কুখ্যাত এক মাদক এলএসডি। অনলাইনের মাধ্যমে কুরিয়ার সার্ভিসে এই ভয়ংকর ড্রাগ বাংলাদেশে ঢুকছে। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এলএসডি উদ্ধার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বিদেশ থেকে কুরিয়ারে এনে অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও কলেজের ছেলের কাছে এই ভয়ংকর মাদক বিক্রি করা হচ্ছে। এই ভয়ংকর মাদক দেশে পৌঁছে যুবক সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তা নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবক মহল। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই এলএসডি আসে নেদারল্যান্ডস থেকে, ‘টিম’ নামের এক ব্যক্তি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওই চালান প্রথম বাংলাদেশে পাঠায়। নিজের গলায় দা চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একটি চক্রের সন্ধান পায়, যারা অনলাইনে এলএসডি বিক্রি করে আসছিল।
ভয়ংকর নতুন মাদক মাশরুম: সম্প্রতি হাতিরঝিল এলাকা থেকে এই ম্যাজিক মাশরুম নাগিব হাসান অর্ণব (২৫) ও তাইফুর রশিদ জাহিনকে (২৩) গ্রেফতার করে র্যাব । তাদের কাছ থেকে মাদক ম্যাজিক মাশরুমের ৫টি বার। প্রত্যেক বারে রয়েছে ২৪টা করে স্লাইড। প্রতিটি বারে ম্যাজিক মাশরুমের পরিমাণ ২৫০০ মিলিগ্রাম। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বিভিন্ন খাবারে কেক ও চকোলেটে মিশ্রিত অবস্থায় সেবন করা হয় এটি। এই মাদক সেবনের পর মানসিক রোগ-সাইকোসিস ছাড়াও অবিরাম হ্যালুসিনেশনের কারণ হতে পারে। এছাড়াও অনিদ্রা, চোখ ফুলে যাওয়ার কারণও হতে পারে। এমনকি এই মাদক সেবনকারীরা জীব-জন্তুর সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। গাছ থেকে অক্সিজেন আসছে কি-না তা অনুভব করে। মাঝে মধ্যে নিজের কাছে অক্সিজেন পাচ্ছে না— এমন অনুভব করলে গাছ জড়িয়ে ধরার মতো কাণ্ডও করে থাকে। এমনকি মাতৃগর্ভের স্মৃতিতেও চলে যেতে পারে। তিনি জানান, পাউডার, ক্যাপসুল হিসেবেও পাওয়া যায় এ মাদক। এটি ব্যবহারের পর সেবনকারীর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটি সেবনের পর ছাদ থেকে লাফিয়েও পড়তে পারেন কেউ। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া যুবকদের মধ্যে কয়েকজন দেশে এ মাদক নিয়ে আসছেন।
ভয়ংকর আইস: দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর আইস। মিথাইল অ্যামফিটামিনযুক্ত ক্রিস্টাল, দেখতে কাচ কিংবা বরফের টুকরার মতো। তাই একে আইস বলে ডাকা হয়। বিভিন্ন দেশে এটি ‘সেবু’ ও ‘ডি মেথ’ নামেও পরিচিত। দুই বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম এই ভয়ংকর মাদক ধরা পড়ে। ইয়াবার উপাদানে তৈরি শত গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদকটির কারবার শুরু হয়েছে ইয়াবার মতোই। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে এই মাদকের কিছু চালান ভিন্ন পথে এলেও মূলত মিয়ানমার থেকে ইয়াবার রুটেই আসছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী নৌপথ দিয়ে দেশে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস।
২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। রাজধানীর জিগাতলার ৭/এ রোডের ৬৮ নম্বর ভবন। ওই ভবনে সন্ধ্যা সাতটায় ঢুকে পড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোকজন। তথ্য রয়েছে, বিশেষ কোনো মাদক উৎপাদন হচ্ছে সেখানে। কিন্তু কোনোভাবেই মাদকের সন্ধান নেই। কিন্তু সোর্স তার বক্তব্যে অবিচল। এরপর শুরু হয় ব্যাপক তল্লাশি। একপর্যায়ে অধিদফতরের রাসায়সিক কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠানো হয়। এরপর ২৫ ঘণ্টার অভিযানে আবিষ্কার হয় ক্রিস্টাল মেথ বা আইস তৈরির কারখানা। হাসিব বিন-মোয়াম্মার রশিদ নামের এক যুবককে আটক করা হয়। দেশে প্রথম এই মাদক উদ্ধারের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। গ্রেফতারকৃত যুবকের বক্তব্যে শুনে হতবাক কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সেই সময়কার ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী পরিচালক বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার উপপরিচালক খুরশিদ আলম জানান, ২০১৮ গ্রেফতারকৃত হাসিব বিন-মোয়াম্মার রশিদ মালয়েশিয়ার নটিংহাম ইউনিভার্সিটির শাখা ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিল। তিনি দেশে ফিরে বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের কাশির ট্যাবলেট সরবরাহ করেন। এরপর সেখান থেকে বিশেষ উপায়ে সিওদ্রোএসিদ্রিন উপাদান বের করে আইস তৈরি করছিলেন। এ বিষয়ে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তিনিই মূলত এই ফরমুলা বাজারে ছেড়ে দেন। এরপর থেকে আইসের প্রতি একশ্রেণির আসক্তি দেখা দিয়েছে ধনীর দুলালদের মধ্যে। আগে যারা ইয়াবায় আসক্ত ছিলেন তারাই মূলত আইসের প্রতি ঝুঁকে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান থাইল্যান্ড হয়ে মিয়ানমার হয়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে এই মাদক দেশে ঢুকছে বলে প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। ইয়াবা পাচার ঠেকাতে বর্ডারে কঠোর নজরদারি রয়েছে সীমান্তরক্ষী বিজিবি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ধনী শ্রেণির ইয়াবাসেবীরা ‘আইস’ নামের নতুন ধরনের মাদক সেবন শুরু করেছে। গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, উত্তরাসহ অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে আড্ডার নামে হাউস পার্টিতে তরুণ-তরুণীরা এটি সেবন করছে। সিসা বারগুলোতে গোপনে সেবন চলছে এই আইসের। গত কয়েক মাসে টেকনাফে দুই কেজি ওজনের দুটি বড় চালানসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অন্তত ২০টি আইসের চালান ধরা পড়েছে। এর দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে চারটি আইসের চালান জব্দ করেছে র্যাব ও পুলিশ। উদ্ধারকৃত প্রায় সব চালানেই আইসের সাদা গুঁড়ো বা কাঁচামাল পাওয়া গেছে।
এস্কাফ: প্রথমবারের মতো কিছুদিন আগে নতুন মাদক এস্কাফসহ মো. জুয়েল (৩০), হুমায়ুন কবির (৩০), মো. সাদেক (২৫) ও মো. লিটন (৩৫) নামে চার মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তাদের কাছে ১৮৪ বোতল এস্কাফ (ঊঝশঁভ) ও ২০০ কেজি গাঁজাও পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, ফেনসিডিল জাতীয় ভারতীয় মাদক এটি। সবজি বিক্রেতা সেজে পিকআপে মাদক পরিবহন করছিল এই চক্রটি। ফেনসিডিল জাতীয় (ঈড়ফবরহব চযড়ংঢ়যধঃব) সমৃদ্ধ সিরাপ ‘এস্কাফ’ দেশে প্রথমবারের মতো জব্দ করা হয়েছে। হারুন অর রশিদ জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ভারত থেকে এস্কাফ এনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে আসছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, দেশের বাইরে প্রস্তুত করা মাত্রাতিরিক্ত কোডিনযুক্ত এধরনের বিভিন্ন নামে মাদক ফেনসিডিলের মতো দেশে আসছে। এসব অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ