ঈদের পর নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকারের খসড়া রূপরেখা নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কাছে যাবে বিএনপি। একই সঙ্গে ‘সরকার হটাও’ আন্দোলন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন এবং তারপর রাজপথের অংশীজনদের নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের যে ঘোষণা বিএনপি দিয়েছে তার খসড়া রূপরেখা ও কর্মসূচি তৈরি করছে দলটি। টাগের্ট— ঐক্য আগ্রহী শরিক ও সমমনাদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করা। পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর মনোভাব অনুযায়ী, বৃহত্তর জোট গঠনের রূপরেখার খসড়াও তৈরি করছে মাঠের প্রধান বিরোধী দলটি। এসব বিষয়ে পর্দার ভেতর ও বাইরে চলছে রাজনৈতিক আলোচনা। বিএনপির শীর্ষ নেতারা আশা করছেন, ঈদুল ফিতরের পর এ নিয়ে সরকারবিরোধী সমমনা সকল দল ও সংগঠনের কাছে যাবে তারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিমূল হবে ‘নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার’ ধারণা।
দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন নয়, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে নীতিগত ঐক্যের মধ্যে আনা। এরপর তাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের কাঠামো এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার কৌশল ঠিক করা। এর ধারাবাহিকতায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে কর্মসূচি নির্ধারণ। তারা বলেন, এ মুহূর্তে দাবি আদায়ে আন্দোলন, নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার— এ তিন লক্ষ্যেই রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় আঙ্গিকে সংস্কারের অঙ্গীকার থাকবে। জাতীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করতে ইতোমধ্যে দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা কাজ শুরু করেছেন। খসড়া রূপরেখা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পেশাজীবী, মানবাধিকার সংগঠনসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আবারো বৈঠক ও আলোচনা করবে বিএনপি। তাদের মতামত নিয়ে চুলচেরা বিশ্নেষণ করে রূপরেখা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হবে। এরপর রূপরেখা ও কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্দোলন, নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার এই লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক পথরেখা তৈরি করা হচ্ছে, সেটি হবে মূলত ‘পরিবর্তনের কর্মসূচি’। যেখানে সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকারি কর্মকমিশনসহ (পিএসসি) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় আঙ্গিকে সংস্কারের অঙ্গীকার থাকবে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই এটা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।’
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, জাতীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করতে ইতোমধ্যে দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা কাজ শুরু করেছেন। ঈদের আগেই এটি তৈরি হতে পারে। এই খসড়া রূপরেখা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পেশাজীবী, মানবাধিকার সংগঠনসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করবে বিএনপি। এরপর রূপরেখা ও কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘নির্বাচনে জিতলে আমরা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করব। দেশে অনেক ছোট দল আছে, যাদের অনেক যোগ্য নেতা আছেন, তারা নির্বাচনে না জিতলেও আমরা তাদের জাতীয় সরকারে নেব।’
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় সরকার ধারণা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দিক থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া আসেনি। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের মনোভাবও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তবে বিএনপির প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারের প্রধান কে হবেন, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। এছাড়াও নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন মত তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো দলের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে বড় দল থেকেই সরকারপ্রধান হবেন। তবে সেটা এখনই জানানো হবে না। সরকারের পতন অথবা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধানের নাম ঘোষণা করা হবে। এখন বিএনপির নেতারা জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা সামনে রেখে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন।
জানা যায়, অনেক দিন ধরেই সরকারবিরোধী সব পক্ষকে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য করার চেষ্টা করছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদসহ অন্তত ৩০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। যদিও এখন পর্যন্ত সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া ভিত্তি পায়নি। উপরন্তু নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার নাকি নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার; এ নিয়ে জোটের নেতাদের মধ্যেই মতবিরোধ দেখা দেয়। ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম আবদুর রব ও ২০-দলীয় জোটের নেতা অলি আহমদ জাতীয় সরকারের পক্ষে মত দেন। তাদের আগেই জাতীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ করে বক্তব্য দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বিএনপির নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকারের প্রস্তাবকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা বলে, দলীয় সরকারের অধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। আর নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপির সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে বিএনপি যদি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে একটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক জোট সরকার গঠন করতে পারে, সেটাকে অনেকে স্বাগত জানাবে।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরিষ্কার করে বলেছেন, একটি নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারপর তাদের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন যারা করেছে, তাদের সবাইকে নিয়ে সকলের মতামতের ভিত্তিতেই ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করা হবে। তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জাতীয় সরকারের ধারণাটি হচ্ছে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের সবাইকে নিয়েই জাতীয় সরকার গঠিত হবে। নির্বাচনে মিত্রদলগুলো জিতলেও সরকারে থাকবে, হারলেও থাকবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ