ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নিরাপদ নয় ঢাকা!

প্রকাশনার সময়: ২৯ মার্চ ২০২২, ১০:২৩

বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ এখন রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। শহরের সব এলাকাতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ দূষণের পাশাপাশি বায়ু দূষণেরও অস্থির অবস্থা। বর্তমানে এ দুইটি সমস্যাই মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ আইন থাকলেও দৃশ্যচিত্রে এই আইনগুলো বাস্তবায়নে অনীহা তৈরি হয়েছে। ফলে পরিবেশ দূষিত হওয়ায় হতাশ ও নিরাশায় ভুগছেন নগরবাসী। পাশাপাশি নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিবেশ দূষণ রোধে পরিবেশ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।

পরিবেশ সংগঠনগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে বিশ্বের সব দেশের তালিকায় ঢাকার নাম প্রথম এসেছে। পাশাপাশি প্রথম থেকে পঞ্চম তালিকায় তো রয়েছেই। বর্তমানে শব্দ দূষণেও শীর্ষে ছয়ে ঢাকা। পরিবেশ দূষণের দিকে তাকালে ঢাকার অবস্থা নাজুক। বসবাস অযোগ্য বলে বিবেচনা করা যায়। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরের ৪টি নীরব জায়গা হিসেবে গবেষণায় পাওয়া জায়গাগুলোও এখন মাত্রাত্তিরিক্ত শব্দদূষণ হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ রোধে কোনো কার্যকর না হওয়ায় পরিবেশ দূষিত আরো বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে। পাশাপাশি ধুলা তো আছেই। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এ প্রভাবে পড়ছে সব বয়সির মানুষের ওপরে। ফলে ঢাকায় বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি ভবিষ্যতে বেড়ে উঠছে অসুস্থ প্রজন্ম। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ সম্পর্কে ধারণা নেই অধিকাংশের। পরিবেশ আইন থাকলেও সেগুলোর কোনো প্রয়োগ না থাকায় দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। সেইসঙ্গে জনগণের অসচেতনতা ও অবহেলাকেও দায়ী করেন তারা। আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবেই শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানান।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭৫ ডিবি। কিন্তু বর্তমানে সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি পাওয়া গেছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দ দূষণে যানবাহনের হর্ন, দ্রুতগতির শব্দ এর সঙ্গে আছে আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনার কাজে ব্যবহূত মেশিনের শব্দ, যা ক্রমাগত অসুস্থ করে তুলছে বৃদ্ধ ও শিশুদের। একইসঙ্গে অসুস্থ মানুষরা ক্রমে ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুর দিকে। হাসপাতাল, স্কুল এবং আবাসিক, বাণিজ্যিক, মিশ্র ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে যে শব্দসীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার তার একটুও মানছেন না কেউ। ফলে অতিমাত্রায় শব্দ দূষণের কারণে বধিরতার পাশাপাশি বাড়ছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা। পাশাপাশি শ্রবণশক্তি কমা ছাড়াও মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হূদরোগ, খিটখিটে মেজাজ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হওয়া, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

বিগত সময়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বসবাসরত মানুষ একটা ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। শহরের বাতাস অনুভব করার জন্য ছিল পাগলপ্রায়। একটু সময় পেলেই ছুটে যেত নদীর পাড়ে কিংবা খোলা জায়গায়। সেখানে গিয়েই পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিত। কিন্তু বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানের শহরের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এখন আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশে নিজেদের জড়িয়ে নিতে সংকচবোধ করে। এর প্রধান কারণ পরিবেশ দূষিত। ঢাকার পরিবেশে বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিটা মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে। পরিবেশ দূষিত থেকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন না হওয়ার কারণেই ঢাকার সার্বিক পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করছেন সাধারণ বাসিন্দারা।

তারা বলছেন, এখন ঢাকার বাতাসে গন্ধ অনুভব করার ইচ্ছে পোষণ করলেও মনের ভিতরে নানা প্রশ্ন জেগে বসে। রাজধানীর কোনো জিনিস পরিবেশে সুরক্ষা নয়। দীর্ঘদিন ধরে নির্মল বাতাস না পাওয়ায় ঢাকার আকাশ এখন বিষ হয়ে আছে।

গত রোববার শব্দ দূষণের বিশ্বের শীর্ষে চলে আসে ঢাকা। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বায়ু দূষণেরও শীর্ষে চলে এসেছে ঢাকা। গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় ঢাকা শহরের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ২৬৭ রেকর্ড করা হয়েছে। ভারতের দিল্লি এবং নেপালের কাঠমান্ডু যথাক্রমে একিউআই ২৩৮ ও ১৭৬ নিয়ে পরের দুইটি স্থান দখল করেছে। বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ২০০ হলে ‘খারাপ’ বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘খারাপ’ বলা হয়, যেখানে ৩০১ থেকে ৪০০ এর স্কোর ‘ঝুঁকিরপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।

প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে— বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলাকে দায়ী করা হলেও বর্তমানে এ তিনটির মধ্যে বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে দাঁড়িয়েছে নগরীর উন্নয়নে সংস্কয়ের কাজ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে।

ক্যাপসের পরিচালক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জাজামান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহর ঝুঁকিপূর্ণ শহর। এ শহরে মানুষ বসবাসের যোগ্য করতে হবে। কারণ, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত ৫ বছর পৃথিবীব্যাপী বসবাসের যোগ্য তালিকা তৈরি করছে। ১৪১টি রাষ্ট্রের যে রাজধানীগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে ঢাকা বসবাসের যোগ্য হিসেবে একেবারে নিচের দিকে অবস্থান। আর যদি আমরা উল্টো দিকে বলি তাহলে অযোগ্য বসবাসের তালিকা ঢাকার স্থান প্রথম। এইভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আন্তর্জাতিকভাবেই ঢাকা বসবাসের জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

তিনি আরো বলেন, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলযট, যানজট, মাটিদূষণ, বৃষ্টিদূষণ, এগুলো লাইট দূষণ যা পরিবেশ সবদিক থেকে একেবারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে। শব্দদূষণ থেকে রক্ষ পেতে ৯৯৯-এ ফোন করে সাধারণ নাগরিকরা রাতের এ ধরনের শব্দ দূষণের অভিযোগ করছেন বলেও আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। রাতে নির্মাণকাজের বিপক্ষে আইন নেই। কিন্তু সেটা জরুরি কাজের ক্ষেত্রে। আইনের ফাঁক গলে এখন অনেকেই দ্রুত কাজ সারতে রাতেও নির্মাণকাজ চালাচ্ছেন। যতদূর সম্ভব নাগরিক সংকট সামলে কাজ করা উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজধানী ঢাকা বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, এটা শুধু ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য নয়। দেশের সকল মানুষ এটা বুঝতে পারেন। এর মূল কারণ এই শহর নিয়ে কারো কোনো দর্শন নেই। বিগত ২০ বছর আগের ঢাকা আর ২০ বছর পরের ঢাকা কেমন হবে তা নিয়ে কার্যকর কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই। নেই কোনো সমন্বয়। শহর রক্ষায় আইন আছে প্রয়োগ নেই।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। ক্রমেই আরো ঢাকামুখী হচ্ছে মানুষ। এটা রোধে কাজ করছেন না কেউ। অন্যদিকে, কৃত্রিমভাবে জমির দাম বাড়িয়ে একটা গ্রুপ নিজেদের ইচ্ছেমতো আবাসন গড়ে তুলছেন। শহরের সবুজায়ন ধ্বংস করা হচ্ছে। বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে ঢাকা। ফলে, পরিবেশে দূষণ বেড়েই চলছে। আইন কার্যকরী না থাকায় বায়ুদূষণে শহরের পরিবেশ রক্ষা আইন ভেস্তে যাচ্ছে। শহরের কাঠামো নষ্ট হচ্ছে। এতে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে ঢাকা।

নয়া শতাবদী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ