ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিকল্পনাকারীরা আড়ালে

প্রকাশনার সময়: ২৮ মার্চ ২০২২, ০৮:৫৪

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার জন্য ঘটনার ৫ দিন আগে ‘কন্ট্রাক্ট’ (চুক্তি) করে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ নামে এক পেশাদার খুনি। তিন দিন আগে সে নাম পায় কাকে খুন করতে হবে। ঘটনার আগের দিন টিপুকে কমলাপুরে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। হত্যাকাণ্ডের জন্য টাকা নয়, আগের কয়েকটি মামলা তুলে নেয়াসহ বিশেষ সুবিধার নিশ্চয়তা দেয়া হয় তাকে। তবে মূল পরিকল্পনাকারী কে— সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি মাসুম। কারণ পরিকল্পনাকারীর সঙ্গে সরাসরি চুক্তি হয়নি খুনির।

সামিয়া আফরান প্রীতিকে গুলি করার কোনো মিশন ছিল না মাসুমের। ঘটনার সময় পিস্তলের ট্রিগার চেপে ধরে রাখার কারণে প্রীতি গুলিবিদ্ধ হয়। পরে টেলিভিশনে খবর দেখে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে।

শনিবার রাতে কিলার মাসুমকে গ্রেফতারের পর গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান একেএম হাফিজ আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, মাসুম মোহাম্মদ আকাশ চাঁদপুরের মতলব উপজেলার কাইশকানি এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে। রাজধানীর পশ্চিম মাদারটেকের ৬০/১৫ বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। তার নামে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। বগুড়া জেলা পুলিশের সহযোগিতায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বগুড়া থেকে তাকে গ্রেফতার করে। হাফিজ আক্তার বলেন, গত ২৪ মার্চ রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে বাসায় যাওয়ার পথে শাহজাহানপুর থানার আমতলা এলাকায় অজ্ঞাত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে জাহিদুল ইসলাম টিপু ও তার ড্রাইভার এবং রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান প্রীতি নামের এক মেয়েকে গুরুতর জখম করে। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও রিকশা আরোহী প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে।

এক পর্যায়ে মাসুমকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শুটার মাসুম জানিয়েছে, ঘটনার আগের দিন ২৩ মার্চ জাহিদুল ইসলাম টিপুকে তার এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় যাওয়ার রাস্তায় অনুসরণ করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বেশি লোকজন থাকায় সে ব্যর্থ হয়। এরপর ঘটনার দিন ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একজন ফোন করে মাসুমকে জানায়, টিপু তার অফিসে (রেস্টুরেন্ট) অবস্থান করছে। এ সংবাদ পেয়ে রেস্টুরেন্টের কাছ থেকে টিপুকে অনুসরণ করা শুরু করে এবং গুলি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু টিপু অনেক লোকজনের মধ্যে থাকায় গুলি করতে না পেরে টিপুর গাড়ি অনুসরণ করে সে।

গাড়িটি শাহজাহানপুর রেললাইনের আগে আমতলাসংলগ্ন রাস্তায় যানজটে আটকা পড়লে মাসুম গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসা টিপুকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি করে। টিপুর মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় সে। ঘটনার পর দুই বন্ধুর সহযোগিতায় নিরাপদ স্থানে আত্মগোপনে যায় শুটার মাসুম। পরে সে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিরপরাধ রিকশা আরোহী প্রীতি এবং টিপুর মৃত্যুর সংবাদ দেখতে পায়। এরপর সে জয়পুরহাট চলে যায়। সেখান থেকে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পার হতে না পেরে বগুড়ায় যায় সে। সেখানে অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর বগুড়া জেলা পুলিশের সহযোগিতায় মাসুমকে গ্রেফতার করা হয়।

কারা মাসুমকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছে জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, যারা কন্ট্রাক্ট দিয়েছে তাদের কয়েকজনের নাম সে বলেছে। টাকা নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সুবিধা পাইয়ে দেয়া, তার নামে মামলা তুলে নেয়ার সুবিধার বিষয় থাকতে পারে।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, শুটিং মিশনে অনেক গুলি ছোড়া হয়। মূল কিলার গ্রেফতার হয়েছে। এখন তদন্তে জানা যাবে মোটিভ। কারা ছিল, কী কারণে খুন, পেছনে কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা চলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, ‘তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি, সে কিলিং মিশনে ছিল। ঘটনার পর ৫/৬ ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চিত হই, কিলিং মিশনে সেসহ দুজন ছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। পালানোর সময় তার কর্মকাণ্ড, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, মোটরসাইকেলের ব্যবহার— এসব মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েই তাকে গ্রেফতার করেছি।

গত ২৪ মার্চ রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে জাহিদুল ইসলাম টিপু মাইক্রোবাসে করে শাহজাহানপুর আমতলা হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে হেলমেট পরা দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে জাহিদুল ও তার গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় জাহিদুলের গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ গাড়িচালক মুন্না বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় পরের দিন শুক্রবার (২৫ মার্চ) দুপুরে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এজাহারে ডলি বলেন, ‘আমার স্বামী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। আমার বাবার মতিঝিল কাঁচাবাজার এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে। আমার স্বামী রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা করতেন। আমার স্বামী বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের ১০ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে দলীয়ভাবে কোন্দল ছিল। গত ৪-৫ দিন আগে আমার স্বামীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার মাইক্রোবাস নিয়ে গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাসহ তিনি এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্টে যান। রাতে বাসায় আসার পথে আনুমানিক সোয়া ১০টার দিকে শাহজাহানপুর মানামা ভবনের বাটার দোকানের সামনে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার স্বামীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলিতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায় এবং আমার স্ব্বামীর গলার ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, বুকের বাম পাশের বগলের কাছাকাছি, পিঠের মধ্যে নাভির নিচে, বাম কাঁধের ওপরে, পিঠের বাম পাশের মাঝামাঝি, পিঠের বাম পাশের কোমর বরাবর, পিঠের ডান পাশের কোমরের ওপর মারাত্মক জখম হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করার সময় প্রীতি নামে এক পথচারীও নিহত হন। নিহত প্রীতি বদরুন্নেসা কলজের ছাত্রী। প্রীতি খুনের বিষয়ে মামলা করবেন না বলে জানিয়েছেন তার বাবা। প্রীতিদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। সেখানে যাতায়াত কম। বাবার চাকরিসূত্রে ঢাকায় থাকেন তারা।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ