রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। স্থানীয় তিন পক্ষের সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধে তিনি খুন হন বলে প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। খুন পরিকল্পনার নেতৃত্বে রয়েছেন দক্ষিণ মহানগর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা (যিনি খুনের আসামি) এবং সুবিধাবঞ্চিত স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশ। এরই মধ্যে একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেয়া ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়দানকারী ও যুবলীগ নেতা বোচা বাবু হত্যার আসামি ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুক ও ২০১৩ সালে খুন হওয়া যুবলীগ নেতা মিল্কীর গাড়িচালক সাগরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হেফাজতে নিয়েছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো পক্ষ থেকে তা স্বীকার করা হয়নি। ওই নেতার সূত্র ধরে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া শুটার দুই ভাই মুসা ও সালেহকে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তারা মিরপুর এলাকায় বসবাস করলেও মুগদা ও শাজাহানপুর এলাকায় আড্ডা দিতেন। ওই দুই ভাই বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি বলেও একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্রমতে, গত দুই বছর ধরে কমলাপুর রেল কলোনি ও শাজাহানপুর গরুর হাট নিয়ে মতিঝিল ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার সঙ্গে বিরোধে জড়ান টিপু। এর আগে তিনি বিদেশে ছিলেন। ক্যাসিনোকাণ্ডে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ জেলে যাওয়ার পর ওই ছাত্রলীগ নেতা কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে খালেদের শাজাহানপুর এলাকার ডিশ ও ইন্টানেটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন।
এ নিয়ে খালেদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে সেই নেতা কিছুদিন আত্মগোপনে যান। এই সুযোগে খালেদের বাগিচা এলাকার ক্যাডারদের নিয়ে টিপু ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিজের আয়ত্তে নেন। সম্প্রতি ওইসব ব্যবসা থেকে টাকার ভাগ পাচ্ছিল না খালেদ ও তার নেতাকর্মীরা।
এ নিয়ে খালেদের সঙ্গে টিপুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। একই সময়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তিবাণিজ্যের একক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় টিপুর হাতে। সম্প্রতি সেখানে ভাগ বসান মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা। গত বৃহস্পতিবারও ওই স্কুলে বিপুলসংখ্যক ছাত্র কর্মচারী কোটায় ভর্তি হয় বলে কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। সেই টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়দানকারী ওমর ফারুকের সঙ্গে ঘটনার দিন সকালেও এজিবি কলোনিতে বিবাদ হয়। তাতে যোগ দেন এক কাউন্সিলর।
এ ঘটনার আগে রেলের একটি বড় ধরনের টেন্ডার নিয়ে মহানগর ওই নেতার সঙ্গেও বিরোধ সৃষ্টি হয় টিপুর। সব বিষয় নিয়ে টিপুবিরোধী পক্ষগুলো এক হয়ে খুনের পরিকল্পনা করে বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও এসব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ইউনিট ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করেছে।
স্থানীয় সূত্রমতে, ২০১৬ সালে মতিঝিল এলাকায় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু খুন হন। বোচা বাবুর বাবা কালামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু টিপু। টিপু হত্যার সময় একই গাড়িতে ছিলেন কালাম। সৌভাগ্যেক্রমে বেঁচে যান তিনি। বোচা বাবু হত্যা মামলায় ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়দানকারী ওমর ফারুক, মিল্কী হত্যা মামলার আসামি সুমনসহ ১০-১২ জন সবাই যুবলীগের নেতাকর্মী।
এই মামলায় ওমর ফারুকসহ সবাই চার্জশিটভুক্ত আসামি। সম্প্রতি একজন মন্ত্রীকে দিয়ে ওমর ফারুক ওই মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়ার সুপারিশ করান। কিন্তু বাদ সাধেন টিপু। এ বিষয়টি নিয়েও ক্ষিপ্ত হন ওমর ফারুক। সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, ত্রিমুখী গেমের সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হন মিল্কী হত্যায় যুক্ত তারই গাড়ির চালক ও দেহরক্ষী সাগর।
অভিযোগ রয়েছে, মতিঝিল এলাকার এক সময় নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট, খালেদ, তারেক ও টিপু। এদের মধ্যে মিল্কী খুনের পর তারেক র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। খালেদ ও সম্রাট জেলে। মিল্কীর নেতাকর্মীদের একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাগর। মিল্কী খুনের সময় সাগরের স্ত্রীর সঙ্গে খুনি তারেকের একাধিকবার কথোপকথনের রেকর্ড পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় মিল্কীর খুনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তার স্ত্রী গ্রেফতার হলেও অজ্ঞাত কারণে রেহাই পায় সাগর। সম্প্রতি সাগরও মতিঝিল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সবার বাধা ছিলেন টিপু। এ কারণে মতবিরোধ থাকলেও টিপুকে সরাতে একজোট হয়েছে বিরোধী পক্ষগুলো। এসব বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল জোনের ডিসি আব্দুল আহাদ নয়া শতাব্দীকে জানান, জোড়া খুনের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম কাজ করছে। আসা করা যাচ্ছে দ্রুতই খুনিদের গ্রেফতার করা হবে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামে একটি বিপণি বিতানের সামনে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। ওই মামলায় টিপু ছাড়াও এসএম জাহিদ সিদ্দিক তারেক ওরফে কিলার তারেক, মো. মাহবুবুল হক হিরক, আবুল মোনায়েম মোহাম্মদ আমিনুল এহসান বাবু ওরফে টমেটো বাবু ওরফে ডিশ বাবু, এনামুল হক, মাসুম উদ্দিন, আহকাম উল্লাহ, ওয়াহিদুল, আলম প্রকাশ ওরফে আরিফ ভূঁইয়া ও তানজিম মাহমুদ তানিম অব্যাহতি পান।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আওয়ামী লীগ নেতাসহ এক ছাত্রী হত্যার ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্তের কাজ চলছে। কাজের অগ্রগতি আছে। খুব দ্রুতই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ও আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার মতিঝিল এজিবি কলোনিতে গ্রান্ড সুলতান নামে রেস্টুরেন্টে কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার পথে রাত সোয়া ১০টার দিকে শাজাহানপুরের মানামা ভবনস্থ বাটার দোকানের সামনে টিপুর মাইক্রোবাসটি থামে। এ সময় রাস্তার বিপরীত পাশে মোটরসাইকেলে দুইজন অপেক্ষা করছিল। হেলমেট পরিহিত এক মোটরসাইকেল আরোহী থেমে থাকা মাইক্রোবাসের বামপাশে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। গুলিতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায়। এতে গলার ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, নাভির নিচে, বাম কাঁধের ওপরে, পিঠের বাম পাশের মাঝামাঝি, পিঠের বাম পাশের কোমর বরাবর ও পিঠের ডান পাশের কোমরের ওপরসহ একাধিক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান টিপু। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা কলেজছাত্রী প্রীতি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী তার শরীরে একটি গুলি ঢুকে অপরদিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। এতে তিনি নিহত হন। এদিকে, টিপু হত্যার বিষয়ে শনিবার সকালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত, নাটের গুরু কারা— সবকিছুই গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে নিয়ে আসা হবে। যারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিনা, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কিলিং পলিটিক্যাল কিনা সেই বিষয়ে এখনই মন্তব্য করতে চাই না। আশা করি খুব শিগগির এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে। কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ