এবার সব ধরনের গ্যাসের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। তবে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে অবিবেচক হওয়ার মতো সিদ্ধান্ত না নেয়ার কথা জানিয়েছেন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান। অন্য দিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক। ব্যবস্থাপনা উন্নত করে, সিস্টেম লস কমিয়ে ঘাটতি মেটানো সম্ভব।
এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে গোঁজামিল তথ্য দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো পাঁয়তারা করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই মুহূতে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লাভবান পর্যায়ে রয়েছে। তারপরেও এটা-সেটা তথ্য দেখিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট খাতের এক অডিট রিপোর্টে বলা হয়, গ্যাস কোম্পানিগুলোর মার্জিন দেখা গেছে (লাভ করছে)। তাহলে কেন দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। জিডিএফ জনগণের পয়সা দ্বারা গঠিত, এরই মধ্যে এখান থেকে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে সরকার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাসাবাড়িতে গ্যাসের দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৯৭৫ টাকা। আর ৭৫০ টাকার এক চুলার জন্য বাড়িয়ে ৯২৫ টাকা করা হয়। পৌনে তিন বছরের মাথায় আবারো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলাসহ সংস্থাগুলো। এবার দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে চায় গ্যাসের দাম।
প্রতি ঘনমিটার ৯.৭০ টাকার বদলে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে গ্যাসের দুই চুলার জন্য গুনতে হবে ২ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে বাড়তি গুনতে হবে ১ হাজার ১২৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে গ্যাসের দাম, বেড়েছে দেশে উৎপাদন খরচও। সঙ্গে পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পেট্রোবাংলার। তবে খরচ বৃদ্ধির যুক্তি যথেষ্ট নয় বলে দাবি করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি বিভাগের হাতে একাধিক বিকল্প ছিল। তারা সেদিকে না গিয়ে দাম বাড়ানোর মতো জটিল পথে গেছে। গ্যাস সরবরাহ আসছে প্রধানত দুটি উৎস থেকে। একটি দেশীয় গ্যাসফিল্ড থেকে উত্তোলন, দ্বিতীয়টি বিদেশ থেকে আমদানি। বিদেশ আমদানি দুই ধরনের চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে। একটি হচ্ছে জিটুজি ভিত্তিতে, আর স্পট মার্কেট থেকে। দেশীয় উৎসের গ্যাসের দাম বাড়েনি, জিটুজি ভিত্তিতে আনা গ্যাসের দামও বাড়েনি। দাম বেড়েছে শুধু স্পট মার্কেট থেকে আনা গ্যাসের। যার পরিমাণ সামান্যই। ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, দাম বেড়েছে স্পট মার্কেট থেকে আনা কমবেশি ৫-৬ শতাংশ। সিস্টেমের ৫ থেকে ৬ শতাংশের দাম বেড়েছে বলে পুরো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়াতে হয় এটা বিশ্বাসযোগ্য। তিনি দাবি করেন, তারা গোঁজামিল দিয়ে হিসেব দেখাচ্ছে, হিসাব বাস্তব সম্মত না। প্রয়োজন হলে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি না করার পক্ষে আমরা। তবুও দাম বাড়ানো উচিত হবে না। প্রথম দিনের শুনানিতে সোমবার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অবিবেচক হবে না বলে জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল। তিনি বলেন, বিইআরসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করে আসছে। কমিশন হচ্ছে আধা-বিচারিক ব্যবস্থা, এখানে যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। আমরা আশা করব, পেট্রোবাংলা তার পরিচ্ছন্ন তথ্য উত্থাপন করবেন। তিনি আরও বলেন, অডিট রিপোর্টে সবার মার্জিন দেখা গেছে (লাভ করছে), তাহলে কেনো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিবেন। জিডিএফ জনগণের পয়সা দ্বারা গঠিত, এখান থেকে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে সরকার। সে বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জিডিএফএ চার্জ ধরা হয় ৮৩ পয়সা, কিন্তু পাচ্ছে ৪১ পয়সা, ৪১ পয়সা অনুদান হিসেবে পাচ্ছে পেট্রোবাংলা। সিস্টেম লস সাড়ে ৮ শতাংশের উপরে। পৃথিবীর কোথাও দুই শতাংশের বেশি নেই। সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য মাত্রায় হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন কমিশনের চেয়ারম্যান। একটি অভিন্ন ডাটা সেন্টার থাকা উচিত বলে মন্তব্য করে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, কোনো সংস্থা তার তথ্যের প্রতি দৃঢ় এবং অবিচল নয়। তার আজকে একটি তথ্য দিলে কয়েকদিন পরে আরেক রকম তথ্য দিচ্ছে। একটি অভিন্ন ডাটা সেন্টার থাকা উচিত। তিনি বলেন, এবার মূল্যহার সুবিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। বাস্তবতার নিরিখে ঘোষণা করা হবে। কোনো অমানবিক সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান বলেন, দাম বৃদ্ধির কারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্প কারখানায় ১১৭ ভাগ এবং গেরস্থালিতে ১১৬ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। তবে কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবার মূল্য নির্ধারণে অবিবেচক হবে না। তিন মাসের মধ্যে গ্যাসের নতুন দাম ঠিক করবে বিইআরসি।
গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বেই : কারিগরি কমিটির সুপারিশ মেনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়ালে বিদ্যুতের দামও বাড়বে। না বাড়িয়ে আর বিকল্প থাকবে না। কারণ, জ্বালানির দাম ১০ ভাগ বাড়লেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবদার করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এবার কমিশন আবেদন মূল্যায়ন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম ২০ ভাগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বিইআরসির কারিগরি কমিটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম ২৫ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৪ টাকা ৪৫ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। কারিগরি কমিটি তা বাড়িয়ে ৫ টাকা ৩৪ পয়সা করার সুপারিশ করেছে। প্রতি ঘনমিটারে বাড়বে ৮৯ পয়সা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত গ্যাসের দাম মূল্যায়নের জন্য কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। মঙ্গলবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাবিত দামের ওপর গণশুনানি হয়। সেখানে সুন্দরবন কোম্পানির প্রস্তাবিত দাম যাচাই করে কারিগরি কমিটি দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে। পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো কারণে জ্বালানির দাম ১০ ভাগ বেড়ে গেলে বিদ্যুতের দাম বদলাতে হবে। এক্ষেত্রে কমিশন কারিগরি কমিটির সুপারিশ আমলে নিলে গ্যাসের দাম ২০ ভাগ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এর আগে আমরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর আলোচনার শুরুতে যে আবেদন জমা দিয়েছিলাম তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, কোনো কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। না হলে সরকারকে বিপুল ভর্তুকি দিতে হবে।
এখন দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৫ ভাগই গ্যাস দিয়ে উৎপাদন হয়। মোট ১৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৫৭টিই গ্যাসচালিত। এরমধ্যে ৩০টি সরকারি ও ২৭টি বেসরকারি। সরকারি কেন্দ্রের মধ্যে পিডিবিরই আছে ১৮টি। জানতে চাইলে পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, গ্যাসের দাম না বাড়ালে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি লাগবে পিডিবির। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়লে এই ভর্তুকিও বাড়বে। গত জানুয়ারিতেই গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো যখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিচ্ছিল তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কমিশনকে চিঠি দেয় পিডিবি। পিডিবি তাদের চিঠিতে জানিয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন তাদের লোকসান হচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বাড়বে। পিডিবি পাইকারি দামে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। বিতরণ কোম্পানি সেটা খুচরা দামে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে।এর আগে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা দাম বাড়ানো হয়। সে সময় পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়। একই সময় গ্রাহক-পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ