ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সেন্টমার্টিনে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও মানব বর্জ্য যাচ্ছে সাগরে

দূষিত হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ
প্রকাশনার সময়: ২২ মার্চ ২০২২, ২১:২৩

সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসা পর্যটক সেবার প্রতিশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে প্রায় দুই শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট, কটেজ আর রেস্তোরাঁ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই গড়ে উঠা এসব স্থাপনায় নেই কোন সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) কিংবা ডাম্পিং স্টেশন। এ অবস্থায় বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে নিঃসৃত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সাগরে। ফলে সাগরের পানি যেমন দূষিত হচ্ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা এ ঘটনার জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেছে সচেতন মহল।

এ পরিস্থিতিতে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ, জৈববৈচিত্র সুরক্ষা, ইকো ট্যুরিজমের উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনাসহ ১৩টি সুপারিশ বাস্তানের দাবি জানিয়েছেন তারা।

সাগরে বর্জ্য ফেলার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, নীতিমালা প্রণয়ন হলে দ্রুত সময়ে সেন্টমার্টিনের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছি।

তথ্য মতে, মাত্র ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে দেশের একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। চারদিকে সাগর বেষ্টিত হওয়ায় শুধু দেশেই নয় বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান এটি। দ্বীপটি সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত। এখানে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যা পর্যটকদের বাড়তি আগ্রহের জন্ম দেয়। প্রতি পর্যটন মৌসুমে দশটি জাহাজে করে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০০ পর্যটক সেন্টমার্টিনে আসা যাওয়া করেন। পর্যটকদের সেবা দিতে গড়ে উঠেছে ১৮৮ টি হোটেল, কটেজ আর রিসোর্ট। আইন অনুযায়ী সেন্টমার্টিনে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা আমলে নেয়নি কোন প্রতিষ্ঠান। সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন বা ডাম্পিং ব্যবস্থা না করে ইচ্ছে মতো স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ অবস্থায় পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য এবং পয়ঃ সাগরে ফেলছে ব্যবসায়ীরা। এসব বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি। আর নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের। ১৯৯৯ সালে সরকার সেন্টমার্টিনকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিকাল এরিয়া (ইসিএ) এলাকা ঘোষণা করেও নিয়ন্ত্রণ আনা যায়নি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। উল্টো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বর্ষা মৌসুমে হোটেলের সেফটি ট্যাংকের ময়লা ফেলা হয় সাগরে। আর যত্রতত্র ফেলে রাখা হয় পর্যটকদের অব্যবহার্য জিনিস।

গবেষকরা বলছেন, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষা করা না গেলে অচিরেই সাগরে তলিয়ে যেতে পারে দ্বীপটি। এ অবস্থায় সেন্টমার্টিনে সব ধরনের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু শরিফ মো. মাহবুবু-ই-কিবরিয়া বলেন, সেন্টমার্টিন আমাদের সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ কর্তৃপক্ষকে সাগরে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। বর্জ্যের কারণে অতিমাত্রায় দুষিত হচ্ছে সাগরের পানি। ইতিমধ্যে গবেষণায় আমরা 'ই-কোলাই' ব্যাকটিয়ার অস্তিত্ব পেয়েছি। যেটির কারণে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

সেন্টমার্টিন রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনের দ্বীপকে রক্ষা করতে সু-পরিকল্পনা দরকার। হোটেল, রিসোর্ট, কটেজসহ সকল প্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং স্টক হোল্ডারের সমন্বয় করে হোটেলের নিঃসৃত সব ধরনের বর্জ্য দ্বীপের বাইরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, পানিতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর কোন জীবাণু পাওয়া গেলে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু এ ধরণের ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিনে অবকাঠামো নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠান তা আমলে নেয়নি। বরং নিজেদের ইচ্ছে মতো গড়ে তুলেছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দিয়েছে।

হোটেলসহ স্থাপনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই স্বীকার করে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৭০টি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁ কোনটির ছাড়পত্র নেই । সম্প্রতি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানও পরিচালনা করছি আমরা।

তিনি বলেন, সরকার সেন্টমার্টিন রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে একটি নীতিমালাও প্রণয়নের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ে একটা নীতিমালা আসবে।

এদিকে, সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, অতীতে কি হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করছি না। কিভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সেন্টমার্টিনকে সাজিয়ে তোলা যায় সেটিই ভাবছি এখন। নীতিমালা প্রণয়ন হলে সেই মতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ