রাজধানী ঢাকার অপরাধ দমনে অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা ও সাইবার ইউনিটের সক্ষমতা বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি কেন্দ্রীয়ভাবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ ইউনিট চালু করেছে ডিবি।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এরই মধ্যে রাজধানীর শতাধিক অপরাধপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো রাজধানীকে এ ধরনের ক্যামেরার আওতাভুক্ত করার কাজ চলছে। রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে খুন, ছিনতাই, চুরির মতো ঘটনা। এসব কাজে বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সক্রিয় থাকছে দুর্বৃত্তরা। আর এসব অপরাধের শিকার হয়ে ভুক্তভোগীরা ঝামেলা এড়াতে থানায় অভিযোগ করছেন কম। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত অপরাধীদের ধরতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) যুক্ত ক্যামেরা বসাচ্ছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগর পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা জানান। রাজধানীতে অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ইন্টেলিজেন্ট সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম তৈরি করার কথা জানান তিনি।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে উন্নত দেশের আদলে সরকারের প্রস্তাবিত সেফ সিটি প্রকল্পের আওতায় ডেভেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখাসহ ‘ঢাকার ঈগলের চোখ’ হবে গোয়েন্দা পুলিশের এই সিসি টিভি পর্যবেক্ষণ ইউনিট।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এই সিসি ক্যামেরাগুলোতে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)। যেটা মূলত মুখমণ্ডল শনাক্তকরণের জন্য নির্দিষ্ট একটি ডিজিটাল পদ্ধতি। এটি একপ্রকার কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন যা ডিজিটাল ছবি বা কোনো ভিডিওর উৎস থেকে একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি এমনকি অপরাধীদের আগের অপরাধের তথ্য-উপাত্তও সংরক্ষণ করে রাখবে। সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের ডাটাবেজে থাকা অপরাধীদের ছবি থেকে ইমেজ অ্যানালাইসিস বা মুখের বৈশিষ্ট চিহ্নিত করে অপরাধীকে শনাক্ত করবে। ডাটাবেজে নির্দিষ্ট অপরাধীদের তথ্য থাকায় এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানান দেবে অপরাধীর অবস্থান সর্ম্পকেও। এ কারণে হত্যা-চুরি-ছিনতাই ইত্যাদি অপরাধ করে পালানোর সময় সংকেত দেবে কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায়, সিসি টিভিতে ঢাকার কোনো এলাকায় অসঙ্গতি দেখতে পেলে পর্যবেক্ষণ নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি নির্দেশনা যাবে। মূলত এটি পুরোপুরি চালু হলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও যানজট নিয়ন্ত্রণে। আধুনিক সফটওয়্যার সংযুক্ত থাকার ফলে সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই অপরাধীর চেহারা শনাক্তসহ তার তথ্য ডাটাবেজ থাকলে সহজেই বের করা যাবে। এই ক্যামেরাগুলো এমনকি গাড়ির নম্বরের দিকেও খেয়াল রাখবে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে নম্বরপ্লেটের ছবি নেবে। এ ইউনিট ডিএমপির ৫০টি থানা ও অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গেও সমন্বয় করবে।
ডিবির ক্যামেরা নেটওয়ার্ক সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যার মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও যানবাহন চলাচলের ত্রুটি ধরতে কাজ করবে এই ক্যামেরা পদ্ধতি। এই প্রকল্পের ক্যামেরার সঙ্গে শুধু ক্রাইম অবজারভেশন নয়, ট্রাফিক সিস্টেমসহ অনেক ফিচার যোগ করা হচ্ছে। ক্যামেরাগুলো জার্মানির উন্নত প্রযুক্তির, যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে অপরাধীকে শনাক্ত করবে। ক্যামেরাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পুলিশ সদরদফতরের আইসিটি শাখাকে দায়িত্ব দেয়া হবে। একটি গাড়ির নাম্বার প্লেট ক্যামেরার সীমানায় এলেই গাড়িটি শনাক্ত হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা হয়ে যাবে। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা, সড়কে নিরাপদ চলাচলে মনিটরিং ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে এ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পর্যায়ক্রমে ঢাকার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমরা সব সময় অপরাধীদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে চাই। সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা। সাধারণত ফোন ট্রাকিং করে গ্রেফতারের বিষয়টি জেনে আসামিরা তাদের মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করে দেন। অপরাধ দমন ও আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশকে তাদের চেয়েও চতুর ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ হতে হয়। এ লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে ডিবির সক্ষমতা ও ডিবির সদস্যদের অভিজ্ঞ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। অপরাধ দমনে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে কাজ করে যাচ্ছি।’
ডিবি প্রধান বলেন, ‘সমপ্রতি সংসদ ভবন এলাকায় মাইক্রোবাসের চাপায় পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্নার মৃত্যুর ঘটনায় ৩৮২টি সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করে গাড়িটির ব্যাপারে ধারণা পান তদন্তকারীরা। গত বছর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা নিয়ে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর, শ্যামলীর হলিল্যান্ড গলিতে বাংলাদেশ গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক আনোয়ার শহীদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেটের দুটি সোনার দোকানে প্রায় সাতশ’ ভরি স্বর্ণালংকার চুরিসহ বেশকিছু ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হয় সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে। এই ক্যমেরা নেটওয়ার্ক পুরোপুরি চালু হলে রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও যানজট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে জানান, ‘এই মেগাসিটিতে প্রায় ৩ কোটি মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনই নতুন মানুষ যোগ হচ্ছে। এমন জনবহুল ও গলি-মহল্লার শহরে কোথাও কিছু ঘটলে তা বের করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। তাই প্রতিটি এলাকা আমরা সব সময়ের জন্য নজরে নিয়ে আসতে চাই। ঢাকা শহরকে নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সেফ সিটি প্রকল্পের আওতায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে অপরাধের ধরন। ঢাকা মহানগরীর অপরাধপ্রবণ যেসব এলাকা রয়েছে সেসব এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে শতাধিক অপরাধপ্রবণ এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। আরো একশ এলাকায় এ ধরনের ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এই সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি থাকবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি মোটরসাইকেলে অপরাধ করে যদি কেউ পালিয়ে যায় সিসি ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোটরসাইকেলের নম্বর চলে আসবে। এরপর ওই মোটরসাইকেলটি ঢাকা শহরের কোন এলাকার কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু সিসিটিভি ক্যামেরার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শনাক্ত করবে। একইভাবে ছিনতাইকারীদের ছবি ক্যামেরাগুলোতে ইনপুট দিয়ে রাখা হবে। এতে ওই ছিনতাইকারীদের কেউ রাস্তায় বের হলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের জানাতে থাকবে ছিনতাইকারী ওমুক রাস্তায় বেরিয়েছে।’
ঢাকা শহরে যতগুলো চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোর নম্বরপ্লেট সফটওয়্যারে যুক্ত করে দেয়া হবে। এরপর বিআরটিএর তথ্য নিয়ে দেখা হবে এই মোটরসাইকেলের মালিক কে। যদি বাইকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ভুয়া থাকে তাহলে ইঞ্জিন নম্বর ও চেসিস নম্বর চেক করে মূল মালিককে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
ডিএমপি কমিশনার জানান, ডিবিতে তৈরি করা অত্যাধুনিক ল্যাবে কোনো অপরাধীর আঙুলের সামান্য ছাপ, ফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা মোটরসাইকেল নম্বরপ্লেট অথবা শুধু তার কিংবা তার বাবার নাম পেলেই ওই অপরাধীকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অপরাধী শনাক্তে একটি মাত্র তথ্য পেলেই যথেষ্ট। অপরাধী দেশের কোথায়, কত অপরাধ করেছে, সেই তথ্যও মুহূর্তের মধ্যে চলে আসবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ