রাজধানীসহ সারাদেশে এক শ্রেণির গৃহকর্মী নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি এসব কাজে জড়িতরা চুরি, ডাকাতি, খুনসহ আঁতকে ওঠার মতো নানা প্রতারণামূলক অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের কাজে রাজধানীতে ১৬টি সংঘবদ্ধ চক্রে ৩ শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এসব কাজে অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের তৈরি অজ্ঞান করার এটিভিএন ট্যাবলেট ব্যবহার করছেন। এসব চক্রের সদস্যরা নাম পরিচয় গোপন রাখতে ফেসবুক গ্রুপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও গৃহকর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। এ ধরনের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হচ্ছেন— অসাধু গৃহকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীরা। গৃহকর্মীরা নানা ধরনের খাবারের সঙ্গে নেশাজাতীয় ওষুধ খাইয়ে বাড়ির সবাইকে অজ্ঞান করে চুরি বা লুট করছেন। আর এসব কাজে বাধা পেলে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গ্রেফতাররা জানিয়েছেন তাদের সঙ্গে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, খুনি, মাদককারবারি ও চোরাই স্বর্ণকারবারি চক্রের যোগাযোগ আছে। অর্থাৎ বাসাবাড়ি থেকে যা চুরি বা ডাকাতি করে নেয়া হয়, প্রত্যেক ধরনের মালামাল কেনার জন্য আছে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট।
রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বাস করেন সুবর্ণা আক্তার। রাজধানীর বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন সুবর্ণা। এর বাইরে তার আর একটি পরিচয় হলো সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্য। কয়েক মাস আগে বনানী এলাকায় শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাসায় কাজ নেন সুবর্ণা। কিছুদিন পর ওই বাসা থেকে স্বর্ণালংকার চুরি করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় রাজধানীর কড়াইল বস্তি ও শাহাজাদপুর থেকে চোর চক্রের সদস্য সুবর্ণা ও তার সহযোগী রবিনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ।এ বিষয়ে ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার রেজাউল হক জানান, চুরির ঘটনায় ৭ ফেব্রুয়ারি বনানী থানায় দায়ের হওয়া মামলাটির তদন্ত শুরু করেন তারা। এরপর রাজধানীর কড়াইল বস্তি ও শাহজাদপুর এলাকায় তারা অভিযান চালিয়ে গৃহকর্মী সুবর্ণা আক্তারসহ তার সহযোগী রবিনকে গ্রেফতার করেন। উদ্ধার করা হয় চুরি হওয়া স্বর্ণালংকার। শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণালংকার বুঝিয়ে দেন ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম।
এডিসি রেজাউল হক জানান, সুবর্ণাকে গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে স্বর্ণালংকার ও ১০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। পরে সুবর্ণার দেয়া তথ্যমতে শাহজাদপুরের একতা জুয়েলার্সের কর্মচারী রবিনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে ১টি স্বর্ণের চেইন ও ১০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, গ্রেফতার আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্য। সুবর্ণা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিত্তবানের বাসায় কাজের বুয়া সেজে কাজ করতে যান। কাজ করার সময়ই স্বর্ণালংকার, টাকা ও মূল্যবান সম্পদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। কিছু দিন কাজ করার পর সুযোগ বুঝে বাড়ির মালিকের অগোচরে বাসার স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সম্পদ চুরি করে পালিয়ে যান। পরে চোরাই এসব স্বর্ণালংকার গ্রেফতারকৃত রবিনের কাছে বিক্রি করে দিতেন তিনি।
সম্প্রতি রামপুরা থানায় এমন আরেকটি মামলায় কুমিল্লার লাকসামে অভিযান চালিয়ে চোরাই স্বর্ণালঙ্কার ও টাকাসহ নূপুর আক্তার নামে এক গৃহকর্মীকে গ্রেফতার করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগ। গোয়েন্দা সূত্র জানান, গত ২৩ জুলাই গৃহকর্মী নূপুর গৃহকর্তার বাসা থেকে সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণালংকার ও টাকাসহ পালিয়ে যায়।
এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, এই চক্রটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর ছদ্মবেশে তাদের লোকদের নিয়োগ করত। পরে সুযোগ বুঝে তাদের পাঠানো গৃহকর্মী বাসার স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।
তিনি জানান, অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে গত ১৯ জুলাই ১০ হাজার টাকা বেতনে নূপুর নামে ওই গৃহকর্মী ভুক্তভোগীর বাসায় কাজে যোগ দেয়। এর দুদিন পরেই ওই গৃহকর্মী বাসা থেকে সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
যুগ্ম কমিশনার জানান, এই ধরনের চুরি-ডাকাতির ঘটনায় আমাদের আসামিদের গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারে বেগ পেতে হয়। কারণ ডিএমপির ভাড়াটিয়া তথ্যভান্ডারে আলাদাভাবে গৃহকর্মীদের তথ্য সংযুক্ত থাকে না। তবে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গৃহকর্মী নূপুরকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হই।
সেক্ষেত্রে কী পরিমাণ চুরি বা ডাকাতির তথ্য ডিএমপি পাচ্ছে জানতে চাইলে যুগ্ম কমিশনার জানান, বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী বা দারোয়ান নিয়োগ দিলে নিকটস্থ থানা পুলিশকে অবহিত করুন। ভাড়াটিয়া তথ্যভান্ডারে তাদের ছবি, পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য সংযুক্ত করুন। তাহলে যে কোনো অপরাধে তাদের দ্রুত আটক করা সম্ভব। এ ঘটনায় জড়িত নূপুরে এর আগে আরো দু’টি চুরির ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি গৃহকর্মী নিয়োগে ডিএমপির পক্ষ থেকে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, গৃহকর্মীর বেশে বাসাবাড়িতে প্রবেশ করে প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে কথিত গৃহকর্মীর হাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। বর্তমানে ডিএমপি নগরীর সব মানুষের তথ্য সংরক্ষণে কাজ করছে। ডিএমপির নির্ধারিত তথ্য ফরমে কাজের লোকের তথ্য পূরণ করে থানায় জমা দেয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
অপরাধের ঘটনা রোধে কাজের লোক নিয়োগের আগে তার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, সদ্য তোলা রঙিন ছবি, শনাক্তকারী ব্যক্তি, ব্যক্তির পরিচয় ও তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য নিকটস্থ থানায় দেয়ার পাশাপাশি নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর ফলে গৃহকর্মী অতীতে কোনো অপরাধ করে থাকলে পুলিশ তাকে সহজেই শনাক্ত করতে পারবেন। প্রয়োজনে পূর্বের কাজের ঠিকানায় যোগাযোগ করে তার তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ও পরামর্শ ডিএমপির। এছাড়া কাজের লোকের পরিবারের তথ্য নেয়া ও তার স্থায়ী ঠিকানা সংরক্ষণ করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এসব চক্রের সদস্যরা চুরি, ডাকাতি, তথ্য পাচার, অপহরণ, হত্যা, খুন, নাশকতাসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকায় বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী বা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে আরো কড়াকড়ি আরোপের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের অপরাধ রোধে এসব নিদের্শনা পালনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গৃহকর্মী বা নিরাপত্তারক্ষী সেজে বাসাবাড়িতে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অপরাধ সংঘটিত করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ ধরনের অপরাধ কমাতে গৃহকর্মী বা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ দেয়ার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিটি থানায় নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনামতে, বাসাবাড়িতে পুলিশের তরফ থেকে ফরমও বিতরণ করা হয়েছে। নির্দেশনায় কাউকে বাড়িতে যে কোনো কাজে নিয়োগ দেয়ার আগে পুলিশকে অবহিত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে বা পুলিশের তরফ থেকে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির ছবিসহ তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। এমন নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। অন্যথায় জীবন ও সম্পদ দুটিই হুমকির মুখে পড়তে পারে।
জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাসাবাড়িতে নিয়োগ পাওয়া অনেক গৃহকর্মী বা নিরাপত্তারক্ষী চুরি বা ডাকাতির মতো অপরাধ করছেন। এ ধরনের অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিক্রয় নিষিদ্ধ নেশাজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করছেন। নেশাজাতীয় ওষুধ চা বা কফির সঙ্গে বাড়ির লোকজনদের খাইয়ে দিচ্ছেন। বাড়ির লোকজন অজ্ঞান হয়ে পড়লে বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের গৃহকর্মীদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের যোগাযোগ থাকে। অনেক সময়ই দেখা যায়, তারা একই চক্রের সদস্য। এজন্য আমদানি নিষিদ্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল ও ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে র্যাবের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ