ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নুন আনতেই হয়রান

আয়ের সিংহভাগই চলে যায় বাজারে
প্রকাশনার সময়: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৩৫ | আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৪৩
ছবি : সংগৃহীত

নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত তো বটেই, বাজারে গিয়ে আজকাল দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন উচ্চ মধ্যবিত্তও। বাজারের আগুনে সাধারণের পকেট আর হাতের সঙ্গে পুড়ছে মনও। অজানা কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এমন নাজুক পরিস্থিতিতেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেন জানি ভাবলেশহীন-নির্বিকার। গণমাধ্যম সরব থাকলেও অখুশি মানুষের হা-হুতাশ যেন পৌঁছাচ্ছে না যথাস্থানে!

নিত্যপণ্যের বাজারে যথারীতি চলছে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। কোন পক্ষ কত বাড়াতে পারে— চলছে যেন সেই লড়াই। আজ তেলের দাম বাড়ছে তো- কাল গ্যাস-পানির। পরের দিন বিদ্যুৎ আর চালের। এভাবেই দাম বৃদ্ধির অসম লড়াইয়ে এক পণ্যের দাম একাধিকবার বাড়ানো হচ্ছে। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ঘোড়ার দৌড়ের মতো বাড়ছে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও বাড়ি ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ। মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীরা মুচকি হাসি হাসলেও নুন আনতে হয়রান মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে ওটার দাম কমার কোনো কথা তো নেই— উল্টো বাড়ছে। শুধু নিত্যপণ্যই নয়, জীবনঘনিষ্ঠ সব উপকরণেরই দাম বেড়েছে। ব্যয় অনুপাতে বাড়েনি আয়। মাসের আয়ের সিংহভাগই চলে যায় বাজারে। সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যয়ে জীবন বাঁচাতে হাঁসফাঁস অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে সরকারের মাথা নেই বলে অভিযোগ জনসাধারণের।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির ফলে মধ্যবিত্ত জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন আরো যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে মানুষের জীবন ধারণ করা অনেক কঠিন। দাম যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনা যায় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। সাধারণ মানুষ বলছেন, দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই দায়। এখনই নিয়ন্ত্রণে না এলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

জানা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া। শীতেও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবধরনের শাক-সবজি। ভোজ্যতেলের মূল্য কয়েকদিন আগে কেজিতে বেড়েছে ৮ টাকা। এ ছাড়া দাম বেড়েছে গ্যাসেরও। পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যে চোখ রাঙাচ্ছে ওয়াসা। এর আগে ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম দাম বাড়িয়েছে সংস্থাটি। ২০০৮ সালে বাসা বাড়ির প্রতি ইউনিটে পানির দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। গ্যাসের মূল্য বেড়েছে আড়াই গুণ, বিদ্যুতে বেড়েছে দ্বিগুণ। এরপরও এসবের দাম আবারো বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে।

খন্দকার শাহাদাত নয়ন নামের এক ভোক্তা বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম এখন আকাশছোঁয়া। যা আয় তা দিয়ে বর্তমান বাজারে মাস চালানো খুবই কঠিন। বলতে গেলে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের দাম এখন অস্বাভাবিক। এই অবস্থায় জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে টিসিবির পণ্য বিক্রয়ের ট্রাকগুলোর সামনে, পয়েন্টগুলোতে ক্রমেই ভিড় বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি স্থানেই টিসিবি যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করে— সেসব স্থানে সাধারণ মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি থাকে। চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকায় দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় মালামাল। শেষ মুহূর্তে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আসা অনেককেই দেখা গেছে মলিন মুখে খালি হাতে বাসায় ফিরতে। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো পণ্য কিনতে না পেরে বিরক্ত ক্রেতারা। বিষয়টি এখন যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে। মহাখালীতে টিসিবি পণ্য নিতে আসা একজন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমি সকাল থেকেই দাঁড়িয়ে আছি। লাইন শেষ হওয়ার আগেই সব শেষ। মানুষ বেশি হওয়ায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। এরপরও পাইনি, যাদের গায়ে জোর আছে তারা ধাক্কাধাক্কি করে নিয়ে যায়।’

মামুন মিয়া টিসিবির পণ্য পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘৩-৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডাল, চিনি, তেল কিনতে পেরেছি।’ গতকাল (বৃহস্পতিবার) এসে ফিরে গেছি। তাই আজ আগে এসেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে টিসিবির পণ্য ছাড়া উপায় নেই। সবকিছুরই দাম বেশি। তাই কষ্ট হলেও টিসিবির পণ্য ছাড়া উপায় নেই।’

পরিসংখ্যান বলছে, করোনার মধ্যেও গত বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় রোজগার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের জীবনমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ধনীদের জীবনযাত্রার মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, গত সোয়া এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে দেশের আড়াই থেকে ৩ কোটি মানুষ। অর্থাৎ সবারই সংকট আয়ের ধারাবাহিকতা। নগদ অর্থে বড় রকমের টান পড়ায় বদলে গেছে আগের জীবন ব্যবস্থাও। জীবন-জীবিকার তাল মেলাতে হিমসিম খাওয়া মানুষের চাহিদা কমে আসছে। তারা উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যয় সংকোচনের পথ।

নিজেদের উপযোগ কমিয়ে দিয়েছে মধ্যবিত্তরা। প্রয়োজন বিবেচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে অগ্রাধিকার খাতকে। প্রয়োজনের সঙ্গে আপস করে অল্প খেয়ে পরে কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত। এসবের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যক্তি খাতের চাহিদা ও ভোগ্যপণ্য বিক্রির ওপর। দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত মধ্যবিত্তরা।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সবকিছুই পাল্টে দিচ্ছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা নেমে এসেছিল ৪০ শতাংশে। এরপর ক্রমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। যেমন— কোভিডের আগে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। মহামারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম জরিপ করে বলছে, ৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র। অর্থাৎ এক কোভিডেই বাংলাদেশ প্রায় ২০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।

মূলত মধ্যবিত্ত যারা, তারাই আয় হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। সুতরাং, মধ্যবিত্ত বিকাশের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি আরো এগিয়ে যাবে বলে যে প্রত্যাশা ছিল, তা অনেকটাই হোঁচট খেয়েছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে গতানুগতিক নীতি বদলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের যে চ্যালেঞ্জ, সরকার তা কতটুকু নিতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সবার আগে আমাদের চাহিদাযোগ্য পণ্য ও সেবার জোগান বাড়াতে হবে। জোগান বাড়াতে হলে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতগুলোকে সচল করে তুলতে হবে। আমদানির উৎস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। এসবের জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও পুনঃবিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। এই বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাত চাঙা হবে। এতে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান বাড়লে আয়ও বাড়বে। আর আয় বাড়লে মানুষের চাহিদাও বাড়বে। আর তাতেই ভালো থাকবে মধ্যবিত্তরা।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘মধ্যবিত্তরাই হলো সমাজের মূল সোপান। তারা ভালো থাকলে দেশের বেশিরভাগ মানুষই ভালো থাকবে। তাই সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি খাতে এক লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার যে প্রণোদনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে, তার সফল বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে। তখন মানুষের ভোগ সক্ষমতাও বাড়বে। এর জন্য আগামী দুই-এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে।’

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘মধ্যবিত্তরা এখন বড় সমস্যায় রয়েছে। সব দ্রব্যের দাম বেশি, তবে করোনার কারণে কমেছে আয়। তারা কখনোই সরকার বা কারো কাছে কিছু চায় না। তারা যে সমস্যায় আছে তা তারা কারোর কাছে বলতেও পারছে না। ফলে করোনায় তারা এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের নিয়ে সরকারের কোনো ম্যাকানিজমও নেই। সরকার জানেও না এই সমস্যায় পড়া মধ্যবিত্তের সংখ্যা কত? অবশ্যই সরকারের নীতি-নির্ধারক যারা আছে তাদের যা করতে হবে তা হলো, পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তারা যদি এই পরিস্থিতি বুঝতে না পারে তাহলে সংকটে যারা আছে তাদের সহায়তা করতে পারবে না। সরকারকে এই শ্রেণির মানুষদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। ফোন নম্বরের মাধ্যমে মানুষের কাছে অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা কার্যকরভাবে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত কিছুটা হাপ ছেড়ে বাঁচবে।’

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ