ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চায়ের হাসি সমতলেও

প্রকাশনার সময়: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৩৭

এক সময় চা আবাদ বা চায়ের বাগান বলতেই মানসপটে ভেসে উঠত বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের ছবি। শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই চায়ের আবাদ- উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতেও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে চা। মাত্র দুই দশকেই দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ উত্তরের সমতলের জেলাগুলো।

বলা যায় চা চাষে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে দেশের উত্তরাঞ্চলের জনপদগুলো। এসব জেলার একসময়ের পতিত গো-চারণ ভূমিগুলোও আজ চায়ের সবুজ পাতায় ভরে গেছে। ফলে দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জনপদগুলোতে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। দিগন্ত বিস্তৃত এসব চা বাগানগুলো চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনেও রাখছে কার্যকর ভূমিকা।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০২১ মৌসুমে সারা দেশে মোট ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা (মেড টি বা তৈরি চা) উৎপাদিত হয়েছে, যা চা উৎপাদনে নতুন জাতীয় রেকর্ড। আর মোট জাতীয় উৎপাদনে পাঁচ জেলার (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট) সমতল ভূমিতে চা উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি। যা মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৫ শতাংশ!

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়। তবে পরের দুই বছরে সেটি কোটি কেজির মাইলফলক অতিক্রম করে। ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি ও সর্বশেষ ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা এবার আগের মৌসুমের চেয়ে ৪২ লাখ ৪০ হাজার কেজি বেশি!

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, উত্তরাঞ্চলে চা-চাষিদের চা আবাদবিষয়ক হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সমতলের চা-বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষে গত বছর ৪১ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে।

সমতলের চা চাষে ভর করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের চা শিল্পখাতও। ভোক্তাসংখ্যা বাড়ায় ও দেশে নেতিবাচক উৎপাদন বজায় থাকায় এক যুগ আগে ২০১০ সালে চা আমদানি করতে হত ব্যবসায়ীদের। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি করা হয়। তবে অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রমেই আরো বড় হলেও সমতলে চা চাষের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আমদানি প্রায় বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি দেশের চা রফতানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে নবম। এর আগে একটানা কয়েক বছর ধরেই দশম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।

সমতলে চা চাষের পেছনের গল্প

চা বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলেন। সে অনুযায়ী পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। প্রথম দিকে টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা চাষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে সর্বপ্রথম তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড (টিটিসিএল) এবং কাজী অ্যান্ড কাজী (বর্তমানে জেমকন গ্রুপ) চা বাগান বাণিজ্যিকভাবে চায়ের বাগান শুরু করে। বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে।

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট ও বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি বিশেষজ্ঞ দল পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় জরিপ চালিয়ে দুটি জেলার প্রায় ৪০,০০০ একর জমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নির্ধারণ করেন। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে পঞ্চগড় জেলায় সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ শুরু করেন ইসহাক আলী মণ্ডল, আব্দুর রহমান, আব্দুল হক, মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, আমেনা খাতুন ও আবুল হোসেনসহ মাত্র সাতজন ক্ষুদ্র চাষি চা চাষ শুরু করেন। আজ চায়ের জেলা হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে পঞ্চগড়। এরপর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়।

বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ২৫ একরের কম বাগানের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ১ হাজার ৭৪৫টি নিবন্ধিত ও ৮ হাজার ৬৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ১১ হাজার ৪৩৪ একর জমিতে চা হচ্ছে। বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় ২২টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা চালু রয়েছে। ক্রমেই চায়ের আবাদ প্রসার লাভ করায় এখন পর্যন্ত চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে ৪১টি কোম্পানি। উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের উন্নয়নে ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর একটি উপকেন্দ্র পঞ্চগড়ে স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে যা বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে সিলেট ও চট্টগ্রামের পর পঞ্চগড়েও সরকারিভাবে চা নিলামকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার গ্রিণ কেয়ার চা কারখানার ব্যবস্থাপক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমরা চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি নগদ মূল্যে চা পাতা ক্রয় করছি। এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ না থাকায় চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। অকশন বাজার (নিলাম কেন্দ্র) চালু হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ হাতে নেয়। উত্তরাঞ্চলে চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নেওয়া এই প্রকল্প ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলে। এর আওতায় চা-চাষিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলের’ মাধ্যমে চায়ের আবাদ সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বল্প মূল্যে উচ্চফলনশীল চারা সরবরাহ করা হয়।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, ‘ চা বাগান মালিক ও ক্ষুদ্র চা চাষিদের জন্য চা বোর্ড প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ লজিস্টিক সাপোর্ট মাঠ পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে পঞ্চগড়ে চায়ের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেখানে চা-বাগানে রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য মিলছে। সে জন্য নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও চাষিরা চা চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন।’ দেশে চায়ের ভোক্তাও ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হওয়ায় বড় বড় শিল্পগ্রুপও চা-শিল্পে যুক্ত হচ্ছে। এ শিল্পে গত দুই দশকে ১৮টি বড় শিল্প গ্রুপ যুক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে গত কয়েক বছরেই চা উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে স্কয়ার গ্রুপ, হা-মিম গ্রুপ, অরিয়ন গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, প্যারাগন, সিটি গ্রুপ, ইস্টকোস্ট, এবিসি গ্রুপ, এমজিএইচ গ্রুপ ও পেডরোলো গ্রুপের মতো বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। তবে বাগান করা ছাড়াও চা বিপণণেও এগিয়ে এসেছে স্বনামখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান যাদের মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের, মেঘনা, পারটেক্স স্টার ও এসিআই গ্রুপ।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ