ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

এলপিজি সংকটের নেপথ্যে

প্রকাশনার সময়: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:১৮ | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:২৬

দেশে গেরস্থালি কাজে জাতীয় গ্রিডের গ্যাসসংযোগ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। ফলে বাসাবাড়িসহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে এলপিজি গ্যাসের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের সংকটও। এই সংকট কৃত্রিমভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে একটি চক্র তৈরি করছেন বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা চক্রটি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এলপিজির খালি সিলিন্ডার সংগ্রহ করে তা কেটে কেজি দরে বিক্রি করে। এতে বাজারে সিলিন্ডারের সংখ্যা কমতে থাকে বা ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে তৈরি হয় এলপিজি সিলিন্ডারের সংকট।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মেঘনা ফ্রেশ এলপিজির চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ নূরুল আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘একটি এলপিজি সিলিন্ডার তৈরিতে আমাদের খরচ হয় ২ হাজার ৬০০ টাকা। আমরা যখন তা ভোক্তার কাছে বিক্রি করছি, তখন সেটি তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ভর্তুকি দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি সিলিন্ডারের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৭০০-৮০০ টাকা। প্রথমবার ব্যবহারে সিলিন্ডারটি খালি হওয়ার পর ভোক্তা যখন আবারো এটি রিফিল করতে ফেরত আসেন, সেখান থেকেই আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করে। এই ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অথচ বাসাবাড়ি বা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খালি সিলিন্ডার কমদামে কিনে নিয়ে কেটে স্ক্র্যাপ তৈরি করছে।’

নূরুল আলম আরো বলেন, ‘বিস্ফোরক আইনে বলা আছে, সিলিন্ডারের আকার পরিবর্তন করা যাবে না। এরপরও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ছে। গ্যাস একটি দাহ্য পদার্থ। তাই গ্যাস সিলিন্ডারকে যেনতেনভাবে কেটে ফেলাও মারাত্মক ঝুঁকির কাজ।’

জানা গেছে, ’৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশে বোতলজাত বা সিলিন্ডার গ্যাসের বাজারজাত শুরু হয়। ’৯০-র দশক থেকে তা বাড়তে থাকে। ব্যবসা-বান্ধব নীতির আলোকে বোতলজাত এই গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করে। এর মধ্যে বর্তমানে ২৯টি প্রতিষ্ঠান বাজারে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে। এ খাতে এরই মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে শতভাগ আমদানিনির্ভর এই গ্যাসের চাহিদা বছরে ১২ লাখ টন। চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, এলপিজির খালি সিলিন্ডার সংগ্রহ করে তা কাটা পরিবেশ ও মানবসমাজের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড বেআইনি।

এলপিজি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ, গত ৮-৯ মাস ধরে বাজারে সিলিন্ডার সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ সিলিন্ডার খালি হওয়ার পর গ্রাহক ফের তা গ্যাস রিফিলের জন্য ফেরত নিয়ে আসার কথা। কিন্তু যে পরিমাণ সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে, তার সব রিফিলের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে আসছে না। প্রতিবারই নতুন করে বাজারে সিলিন্ডার ছাড়তে হচ্ছে। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

এলপিজি সেক্টরের বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করার মাধ্যমে বাজারে সিলিন্ডারের সংকট তৈরি করে এলপিজির দাম অস্থির করার চেষ্টা করছে অসাধু সিন্ডিকেট। সিলিন্ডারের সংকট তৈরি হলে বাড়তে পারে ভোক্তা খাতের এলপিজির দাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলপিজি ডিলার বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে চোরাইভাবে এলপিজি সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর পাহাড়তলী, ফৌজদারহাট এবং লোহাগাড়ার পদুয়া এলাকায় বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি স্ক্র্যাপ লোহার মূল্য ৫০ টাকার বেশি। একটি সিলিন্ডার কাটলে ৬০০ টাকার লোহা ও ৮০-১০০ টাকায় বাল্বটি বিক্রি হয়। এতে একটি সিলিন্ডার কাটলে ১০০ টাকার মতো লাভ হয় সিন্ডিকেটের।

পদ্মা এলপিজির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েক দিন থেকে শুনে আসছিলাম পদুয়া এলাকায় একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিলিন্ডার কেটে রোলিং কারখানায় স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করছে। বাজারে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পদ্মা, লাফস, বিন হাবিব, কর্ণফুলী, বসুন্ধরা, ওমেরাসহ অনেক কোম্পানির খালি সিলিন্ডার কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টিল রি-রোলিং মিল ও স্ক্র্যাপ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবহূত খালি সিলিন্ডারগুলো সংগ্রহ করছেন। পরে তা কেটে ও গলিয়ে স্ক্র্যাপ তৈরি করে কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, শরিয়তপুর, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, বাগেরহাটের কাটাখালী, খুলনার শেখ পাড়া, কুষ্টিয়ার বড় বাজার, ফরিদপুরের কমরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহক বাড়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে তৈরি, খরচের চেয়ে কম দামে সিলিন্ডার বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এই ব্যবসার ধরন হলো— ভোক্তা যখন তার খালি সিলিন্ডার রিফিল করতে ফেরত আসবেন, সেই লভ্যাংশ থেকেই ক্রমান্বয়ে মুনাফা পাবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাসাবাড়ি বা বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খালি সিলিন্ডার কমদামে কিনে নিয়ে কেটে স্ক্র্যাপ তৈরি করছে। অবৈধভাবে স্ক্র্যাপ তৈরির কারণে এলপিজি সিলেন্ডার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সূত্র মতে, খালি সিলিন্ডারগুলো কেটে ও গলিয়ে স্ক্র্যাপ তৈরি করার অভিযোগে সম্প্রতি এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (লোয়াব) পক্ষ থেকে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী লোয়াবের ম্যানেজার আফজালুর রহমান।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৬ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোডের সফিউল আলম স্টিল মিলসের সামনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি এলপিজি সিলিন্ডারের টুকরাবোঝাই ৭টি ট্রাক দেখেন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা। তারা পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ট্রাকগুলোকে জব্দ করে। এজাহারে আরো বলা হয়, সিলিন্ডারের আকৃতি পরিবর্তন বা কাটা নিষিদ্ধ হওয়ার পরও মুনাফালোভী এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন জায়গা থেকে এলপিজি সিলিন্ডার সংগ্রহ করে তা স্ক্র্যাপ করছে। এরপর তা কেজি দরে বিক্রি করছে। এই মামলায় কুমিল্লার সফিউল আলম স্টিল মিলসের স্বত্বাধিকারী সফিউল আলম ছোটন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও চট্টগ্রামের মুদারপুরের মেসার্স মনসুর অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারীকে বিবাদী করা হয়েছে। কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সহিদুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এলপিজি সিলিন্ডার কেটে টুকরো করে বিক্রির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এই বিষয়ে তদন্ত চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এ ব্যাপারে মামলার অন্যতম বিবাদী সফিউল আলম স্টিল মিলসের স্বত্বাধিকারী সফিউল আলম ছোটনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদফতরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মোহাম্মদ আবদুল হান্নান বলেন, ‘এক্সপ্লোসিভস অ্যাক্ট ১৮৮৪’-এর অধীনে ‘গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ১৯৯১’-এ বলা হয়েছে, ‘সিলিন্ডারের রং পরিবর্তন করা যাবে না। কেউ কোনো সিলিন্ডার কাটতে পারবে না। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সিলিন্ডারের আকৃতি পরিবর্তন-পরিমার্জন করার সুযোগ নেই। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহন, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহারসহ প্রতিটি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটানো আইনের লঙ্ঘন। আর তা পরিবেশ ও জান-মালের জন্যও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে বলেও জানান তিনি।’ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সূত্র বলছে, দেশে মোট ৫৬টি কোম্পানি এলপিজি ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিয়েছে। ২৮টি কোম্পানি বর্তমানে বাজারে সক্রিয়। এর মধ্যে ২০টি কোম্পানি সরাসরি আমদানি করে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশে ২০০০ সালে প্রথম এলপিজি সরবরাহ শুরু করে বসুন্ধরা।

এরপর সিলিন্ডার উৎপাদনে আসে ওমেরা, ওরিয়ন, মেঘনা, যমুনা, নাভানার মতো ব্র্যান্ড। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এলপিজি আমদানি, বোতলজাত ও বাজারজাত করছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন প্রায় ৭০ লাখ পরিবার এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। এই এলপিজির চাহিদার মোট ৯৮ শতাংশই সরবরাহ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। আবার গত এক দশকে প্রতিবছরে গড়ে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে এলপিজির চাহিদা।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ