ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দ্বিমুখী আচরণে গ্যাস কোম্পানিগুলো

প্রকাশনার সময়: ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৫

শত শত কোটি টাকা মুনাফা করলেও এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস সঞ্চালন, উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম বাড়ানোর এমন দৌড়ঝাঁপকে অনেকেই বলছেন দ্বিমুখী আচরণ। যদিও এরই মধ্যে এর বিরোধিতা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। আবার এই প্রস্তাবকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

জানা গেছে, তিতাস গ্যাস কোম্পানি গত চার বছরে ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রির ২২ ভাগই মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। অথচ এখন তারাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে কমিশনে দৌড়ঝাঁপ করছে। অনেকেই একে বলছেন দ্বিমুখী আচরণ। আবার গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। একচুলা ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব জমা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। পেট্রোবাংলা থেকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অভিন্ন প্রস্তাব জমা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চীন ও ভারত আরো ২০ বছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখবে। বাংলাদেশেও শিল্পের বিকাশের স্বার্থে দেশে মজুদ থাকা কয়লার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া উচিত সরকারের। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাপেক্স একা না পারলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বে অনুসন্ধান কূপ খননে গতি আনা উচিত।

জানা গেছে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গত ৩ জানুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠাতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়। পরে পেট্রোবাংলা আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দামসহ বিভিন্ন চার্জ ধরে খসড়া হিসাব বিতরণ কোম্পানিগুলোকে পাঠানোর পর বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কমিশনে পাঠায়। অথচ বিইআরসি সূত্র বলেছে, দেশে যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার প্রায় ৭৮ শতাংশ আসে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে। কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি হয় মোট সরবরাহের ১৭ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই ৫ শতাংশ গ্যাসের বাড়তি দামের নামে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার ন্যূনতম যৌক্তিকতা দেখছেন না ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এলএনজির দাম বাড়ার অজুহাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। মাত্র ৪-৫ শতাংশ এলএনজি কেনা হয় খোলাবাজার থেকে। এই অজুহাতে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। দেশীয় গ্যাসের দাম বাড়ানোরও কোনো কারণ নেই। এলএনজি, যেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কেনা হয়েছে তার দামও বাড়ানোর দরকার নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রয়োজনে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে রেশনিং করা হোক। কিছুদিন আগে তেলের দাম বাড়িয়ে যে সর্বনাশ হয়েছে, এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ালে নিম্নআয়ের মানুষ ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। দেশের অর্থনীতিও হুমকিতে পড়বে।’

বিইআরসি বলেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করতে হলে প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব দিতে হবে। বিতরণ কোম্পানি তা করেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় নথিও জমা দেয়নি। তাই তাদের নিয়ম মেনে আবেদন করতে বলা হয়েছে।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে তথ্যের ঘাটতি থাকায় প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে।’

কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এখন সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। এরমধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমাদের দেশীয় উৎস থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন যে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে তার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট দশ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা। ফলে এখানে দামের হেরফের হয়নি। স্পট মার্কেট থেকে যে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কেনা হচ্ছে তার দামের হেরফের হয়েছে শুধু। ওটার জন্য গ্যাসের দাম কেন দ্বিগুণ করতে হবে।

স্ট্যান্ডিং কমিটির ডিরেক্টর-ইন-চার্জ ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবুল কাশেম খান বলেন, দেশে জ্বালানি খাতে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ নয়। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও শিল্পায়ন অব্যাহত রাখতে দেশীয় সম্পদকে কাজে লাগানো জরুরি। কয়লা উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে মত দেন তিনি।

গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলাসহ তিতাস, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। একইভাবে বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।

পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে ভবিষ্যতে এলএনজি আমদানিতে বিতরণ ব্যয় বাড়বে। সেজন্য দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু যে ব্যয় বাড়েনি আগেভাগে সেটা দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। কমিশন আইন অনুযায়ী এসব গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলার ব্রেক ইভেন লাভ-লোকসানের সমতা বিন্দু পর্যন্ত দাম বাড়ানোর প্রবিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে এতদিন গ্যাস বিক্রি করে কীভাবে কোম্পানিগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে কমিশন প্রয়োজনের তুলনায় আগে থেকে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছে।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘এই ধরনের প্রস্তাব নিতান্তই অবাস্তব। কদিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিবহনে অরাজকতা তৈরি হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ালে একই যুক্তিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। তাই এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবে না। তাছাড়া মুনাফা করলেও গ্যাসের কোম্পানিগুলো অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর এমন দৌড়ঝাঁপ দ্বিমুখী আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।’

সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে গড় মূল্য ১১৬ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান দাম প্রতি ঘনমিটারে ৬ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৯৪ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা আরো এক কাঠি এগিয়ে। তারা বলছে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম হতে হবে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, প্রতিদিন গড়ে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি ধরে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিনই পেট্রোবাংলা এ পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেনি। গড়ে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করে। বছরে কখনো সংকট বাড়লেই ৮০০-৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে দেখা গেছে। সাধারণত গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে ওই সময়ে অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, অতীতে কখনোই এত বেশি পরিমাণে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। এমন প্রস্তাবকে নজিরবিহীন বলা ছাড়া অন্য কিছুই বলা যায় না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো তাদের মতো করে প্রস্তাব দিয়েছে। এখন দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

বাখরাবাদ তাদের প্রস্তাবে আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা, সিএনজিপ্রতি ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.০২ টাকা, ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে ৩০.০৯ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বিদ্যমান দর ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া চা শিল্পে বিদ্যমান দর থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গড় হিসেবে বিদ্যমান ৯.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, ‘ভবিষ্যতে জ্বালানির কথা বিবেচনা করে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন যে দামের প্রস্তাব দিয়েছে তা অনেক বেশি। কমিশনের বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ