ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ছাত্র-জনতার আন্দোলন: সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেন সাংবাদিক জুলকারনাইন

প্রকাশনার সময়: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৩:০১

ছাত্র-জনতার রক্ত আর হাজারো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচার শাসনের অবসান হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান।

বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে ১৯৭১ সালে এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আগে-পরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করেন এই সাংবাদিক।

পাঠকের সুবিধার জন্য জুলকারনাইনের পোস্টটি হুবুহুবু নিচে তুলে ধরা হলো-

অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় যা আপনাদের জানা উচিত-

১। ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনী স্বশরীরে যুদ্ধে ঝাপিয়ে না পড়লে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা যতটা কঠিন ছিলো, ৫ আগস্ট বা তার আগে-পরে সেনাপ্রধান ও তার বাহিনী অভিভাবকের ভূমিকা না নিলে রক্তের বন্যায় দেশ তো ভাসতোই সাথে স্বৈরাচারের পতনও অনিশ্চিত হয়ে যেতো। ০৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতাকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, যারাই এই বাহিনী এবং বাহিনী প্রধান সম্পর্কে খুচরা আলাপ করছেন, বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছেন, তারা অনুগ্রহ করে এই গোটা প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিজ বুদ্ধিতে বিবেচনা করবেন।

২। স্বৈরাচার পতনের পর বর্তমান সেনাপ্রধান (জেনারেল ওয়াকার) সর্বপ্রথম দেশের সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অন্যতম মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। আলোচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের আমন্ত্রন জানানো হলেও পরবর্তীতে ছাত্রদের অনুরোধে তাদের পক্ষ হতে প্রফেসর Asif Nazrul যোগদান করেন। পতিত সরকারের ষান্ডা-পান্ডারা যখন দেশে ডাকাতি-চুরি আর লুটতরাজের স্বর্গরাজ্য কায়েম করতে চেয়েছিলো, জেনারেল ওয়াকার আর তার বাহিনীই কিন্তু দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় সক্রিয় হয়েছিলো। বন্যায় যখন দেশটা নাকাল হয়েছে, অশুভ শক্তি যখন তৈরী পোশাক শিল্পখাত ধ্বংসের পায়তারা করছিলো, তখনো এই সেনাবাহিনীই মাঠে নেমেছে, কোন রাজনৈতিক দল বা বিদেশি শক্তি নয়।

৩। এদেশের রাজপথ আর রাজপথের লড়াকু ছাত্র-জনতা স্বাক্ষী — শেখ হাসিনা গদি টিকিয়ে রাখতে সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামালেও সেনাবাহিনী মাঠে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে সাধারণ ছাত্রদের সেনাবাহিনীর সদস্যরাই রক্ষা করেছিলো। বর্তমানে কথার ফুলঝুরি ফোটানো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং সো-কলড বুদ্ধিজীবিরা ঠিকই এসি রুমে বসে এই দৃশ্য দেখছিলো।

৪। জেনারেল ওয়াকার পারিবারিকভাবে শেখ হাসিনার কাজিনের স্বামী নাকি জো বাইডেনের বড় ভাই সেটা মূখ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় হলো তার পেশাদারিত্ব। সেনাবাহিনীর পবিত্র পোশাক গায়ে জড়িয়ে জেনারেল ওয়াকার সেই পোশাকের মর্যাদা রেখেছেন। সম্পর্কের চেয়ে দেশের মানুষের প্রতি টান, সার্বভৌমত্বের দায় থেকে সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেদিন যে ভূমিকা রেখেছেন তা নিশ্চিত ভাবেই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। সেদিন যদি জেনারেল ওয়াকার বিন্দুমাত্রও শেখ হাসিনাকে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে কোন অনৈতিক সুবিধা দিতেন তাহলে দেশটা হয়তো শ্মশানে পরিণত হতো।

৫। ছাত্র-জনতা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরে আসা দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর প্রতি দেশবাসীর যৌক্তিক প্রত্যাশা অনেক। সেই দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশের সেনারা আবারও কোন স্বৈরাচারের হাতে দেশটাকে তুলে দিয়ে চায় না বরং উপযুক্ত সময়ে সেনাবাহিনীর অধীনে দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তারা চান। ইতোমধ্যেই বাহিনীর প্রধান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ক্ষমতা দখলের কোন ইচ্ছে সেনাবাহিনীর নেই। দেশের মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতেই তিনি বলেছেন, যথা সময়ে দেশে নির্বাচন হবে আর সেনাবাহিনী সুষ্ঠু একটি নির্বাচন আয়োজন এবং সম্পন্ন করতে বর্তমান অন্তর্বতী সরকারকে সর্বাত্নক সহায়তা করবে।

৬। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা থাকা উচিত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমানে সেই ভূমিকাই পালন করছে ও করে যাবে। বর্তমান সেনাপ্রধান সরকারের সাফল্যের জন্য সর্বাত্মক সহযোগীতা করছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেনাপ্রধান সাক্ষাৎ করতঃ বিভিন্ন বিষয়াদির ব্যাপারে আলোচনা ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা গ্রহণ করতঃ কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

৭। সম্প্রতি রয়টার্সের সাংবাদিকের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে সেনাপ্রধান তার ব্যক্তিগত মতামত হিসাবে ১৮ মাসের বিষয়টি উল্লেখ করেন, সামরিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যায় এটি অফিসিয়াল কোন বক্তব্য নয়, তবে রয়টার্সের সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাতকার দেওয়ার বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা নিজে অবগত ছিলেন।

৮। ৫ আগস্টের পরে সকল পুলিশ থানা প্রায় অকার্যকর হয়ে যায়, থানাগুলোর কর্মক্ষমতা আবার ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে সেনাবাহিনী। ম্যাজিষ্ট্রিসি পাওয়ার না থাকায় সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করা যায়নি কয়েকদিন। পরবর্তীতে ম্যাজিষ্ট্রিসির ক্ষমতা পাওয়ায় সব হায়গায় আইনশৃংখলার উন্নতি হচ্ছে। বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনী যৌথভাবে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীকে। এই মূহুর্তে দেশ গঠনে তারা ঐক্যবদ্ধ। বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে ফাংশনিং করার জন্য সেনাবাহিনী অনবরত সহযোগীতা করছে। সেনাপ্রধান হিসাবে যখন যেই কাজ করা প্রয়োজন সেটাই তিনি সাবলীল ভাবে করে যাচ্ছেন। একজন সৎ সেনা প্রধানের বিরুদ্ধাচারণ করে বিশেষ একটি গোষ্ঠি আসলে কি করতে চাচ্ছে? দেশে বিদেশি শক্তি বৃদ্ধি নাকি কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন?

৯। ৫ ই আগস্টের পর থেকে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে , সুবিধাবাদী একটি গ্রুপ এই সুযোগ কাজে লাগানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ টাকা উদ্ধারের নামে বিভিন্ন টাকা লুট/ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। কিছু কিছু ঘটনা ইতিমধ্যেই ধরা পরেছে। আর কিছু ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজা নামের এক সেনাকর্মকর্তাকে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকায় তার নামটি গোয়েন্দা রাডারে ধরা পড়েছে বিধায় বর্তমানে তার বিরুদ্ধে তদন্ত আদালতের কার্যক্রম চলমান আছে।

১০। ০৫ আগস্ট ২০২৪ এর পূর্বে আদিবাসীদের একটি অংশ (ইউপিডিএফ মূলের চাপে) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে আলাদাভাবে নিজস্ব বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। পরবর্তীতে, গত ০৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে সরকার পতনের পরে সময়টি দাবি আদায়ে উপযুক্ত বিবেচনা করে পার্বত্য ৩ জেলায় ইউপিডিএফ (মূল) দল কর্তৃক এ সময়কে কাজে লাগিয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্ত্বার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, আদিবাসীদের ৫% কোটা পুনর্বহাল, সেনা প্রত্যাহার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারী মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি, ভূমি বিরোধ সমাধান ইত্যাদির দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করে। পুলিশ এবং বিজিবি টহল দলের কম সক্রিয় থাকার সুযোগে ইউপিডিএফ (মূল) দল সশস্ত্র শাখার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং ব্যক্তিবর্গদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অরাজকতামূলক কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য করে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়/পরিবহনযোগে তাদেরকে খাগড়াছড়ি সদরে নিয়ে এসে আন্দোলন জোরদার করার প্রচেষ্টা চালায়।

১১। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠি উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে উস্কানি প্রদান করছে, এবং এরই মধ্যে ২/৩ জনকে গুম করেছে। সশস্ত্র গোষ্ঠি এ সমস্ত কাজকর্ম করেছে যেন শান্তি প্রিয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী হার্ড লাইনে অবস্থান গ্রহণ করেছে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা যায়, এবং সেসব ছবি/ভিডিও ফুটেজ নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করে আর্ন্তজাতিক সংস্থা/ জাতি/গোষ্ঠীর কাছে সহানুভূতি পাবার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করবে ও নিজেদের দাবিকৃত সেনা প্রত্যাহার দাবিটি আদায় করতঃপার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার স্বাধীনতা দাবী করার অপপ্রয়াস চালাবে।

১২। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতির জন্য নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক হার্ড লাইন এ না যেয়ে আদিবাসী ও বাঙালি দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি করতঃপর্যটকদের অবাধে ৩ পার্বত্য জেলায় গমনের সুযোগ করে দেয়া হবে।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ