ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
বিএলআরআই’র মহাপরিচালক 

কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেও পদে বহাল জাহাঙ্গীর হোসেন!

অপসারণর দাবি
প্রকাশনার সময়: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:১০

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের প্রাণী এবং পোল্ট্রিসম্পদ নিয়ে গবেষণা করা জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)। ২০২১ সালে বিএলআরআই’র মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ পান ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। ব্যক্তি জীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা জাহাঙ্গীর ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হয়েই পরিচালক বানান তার স্ত্রী ড. নাসরিন সুলতানাকে। শুধু এখানেই থামেননি তিনি। এরপর মেতে উঠেন ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠানকে আত্মীয়করণের খেলায়। গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিজের আত্মীয়, দলীয়কর্মী এবং মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদান করা ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।

বিএলআরআইতে ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্য সংবাদও প্রকাশ করেছে। সংবাদ প্রকাশ হলেও, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তের অনলাইন পোর্টালে ‘বিএলআরআইতে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। বিএলআরআইয়ের একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ফোন করে এই ঘুষ দাবি করেন।’

ঘুষ দাবি করার ওই অডিও রেকর্ডটি এসেছে নয়া শতাব্দীর এই প্রতিবেদকের কাছে। কল রেকর্ডে শোনা যায়, ইনস্টিটিউটের ছাগল উন্নয়ন গবেষণা বিভাগের সায়েন্টিফিক অফিসার লিপি রানী সরকার তার ব্যবহৃত মোবাইল ও হোয়াটসআপ থেকে একজন চাকরিপ্রার্থীকে কল দেন। কল দিয়ে তিনি বলেন ‘প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী পরিচালক নাসরিন সুলতানা এবং অতিরিক্ত পরিচালক জিল্লুর রহমান পুরো বিষয়টা দেখভাল করছেন। টাকা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে মহাপরিচালকের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা নিজেই এ বিষয়ে কথা বলবেন।’

কল রেকর্ডে লিপি রানী সরকার আরও বলেন, ‘ডিজি জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নাসরিনের বান্ধবী মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা। যারা এর মধ্যে চাকরির জন্য টাকা দিয়েছে তারা ডিজির স্ত্রীর কাছে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ওই চাকরিপ্রার্থীকে ৬-৭ বার কল দিয়েছি। আপনারা প্রস্তাবে রাজি হলে মৌখিক পরীক্ষার আগে আপনাদেরকে কিছু প্রশ্নপত্র সরবাহ করা হবে এবং আপনাদের চাকরি নিশ্চিত করা হবে।’

ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে বিএলআরআই ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেও জমা পড়েছে অভিযোগ। সে সব অভিযোগে বলা হয়, চাকরিপ্রত্যাশী ২২ জনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা করে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা ঘুষ আদায় করেছেন এস এম জাহাঙ্গীর।

অভিযোগে আরও বলা হয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য ২০২২ সালের ২৭ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ২৮ মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের একাধিক কর্মকর্তাদের প্রার্থীদের কাছ থেকে ২০ লাখ করে টাকা দাবি করেন।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক নাসরিন সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, এগুলা মিথ্যা, বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নাই। মানুষ হচ্ছে প্রতিহিংসা পরায়ন, এসবের পিছে বেশি শ্রম-ট্রম নষ্ট কইরেন না, বুঝছেন? এগুলা প্রত্যেকটি কথা মিথ্যা।

কল রেকর্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিও কল রেকর্ডটা শুনেছি। ১৯৯৭ সাল থেকে আমি সরকারি চাকরি করছি। আর এই মেয়েটা ২০২১ সালে নিয়োগ পেয়েছে। এমন জায়গায় বসে আমি মেয়েটার সঙ্গে এসব কনভারসেশন কিভাবে করি? ও তো আমার আশপাশেই আসতে পারে না। ভয়ে কাঁপতে থাকে।

দৈনিক নয়া দিগন্তের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাকরিপ্রত্যাশী একাধিক ভুক্তভোগী জানান, ‘লিপি রানী সরকারসহ কয়েকজন কর্মকর্তার মাধ্যমে মহাপরিচালকের স্ত্রী নাসরিস সুলতানা চাকরিপ্রার্থী ২২ জনের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকারও বেশি আদায় করে তাদের চাকরি নিশ্চিত করছেন। ভুক্তভোগীরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও ফোন করে অভিযোগ করেন।’

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে লিপি রানী সরকারকে ফোন করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করা হলে তথ্য কর্মকর্তা দেবজ্যোতি ঘোষ বলেন, লিপি রানী সরকার অসুস্থ্য। তিনি অফিস করছেন না। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।

এসব বিষয় নিয়ে বিএলআরআই’র বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় নয়া শতাব্দীর এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আপনার অভিযোগ সত্য। কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার তথ্যও সত্য। তবে ভয়ে কেউ কিছু বলে না। মহাপরিচালক আওয়ামী লীগ করেন। আগস্ট মাসের পনেরো তারিখ আমাদের শোক দিবসের ব্যাজ পড়ার কথা থাকলেও এক তারিখ থেকে কালো ব্যাজ পড়তে বাধ্য করেন তিনি। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কর্মকর্তাদের জোর করে মিছিল, মিটিংয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি।

ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন এসবের সঙ্গে জড়িত। তবে তার স্ত্রী নাসরিন সুলতানা এসব বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখান এবং খোঁজ রাখেন। নাসরিন সুলতানাসহ সহকারী পরিচালক ড. মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তা এই নিয়োগ বাণিজ্য দেখভাল করেন।

জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের বিপক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি করেছেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন। অফিসহকারীদের রাস্তায় নামিয়ে আওয়ামী লীগের হয়ে স্লোগান দিয়েছেন তিনি। সেসব স্লোগানের ভিডিও পৌঁছেছে নয়া শতাব্দীর এই প্রতিবেদকের কাছে।

এদিকে গত পাঁচ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে যান বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পদত্যাগের পর বিভিন্ন বাহিনী, মন্ত্রণালয়সহ সরকারি অফিসে রদবদল শুরু হয়েছে জোরেসোরে। তবে, এখনও বহাল তবিয়তে আছেন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন। ফলে, তার পদত্যাগের দাবি করছেন অনেকেই। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিত মাধ্যমে চলছে এই আলোচনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই শিক্ষার্থী বলেন, এতো বছর পড়াশোনা করেও যদি বিশ লাখ টাকা দিয়ে চাকরীতে ঢুকতে হয়, তাহলে এই পড়ালেখা করে লাভ কী? কারো যেন টাকা দিয়ে, ঘুষ দিয়ে, তোষামোদ করে সরকারি চাকরীতে ঢুকতে না হয়, সেজন্য জাহাঙ্গীর হোসেনের পদত্যাগ চাই। শুধু জাহাঙ্গীর হোসেন না, এমন অসৎ আরও যতো কর্মকর্তা আছেন, সবার পদত্যাগ চাই।

চাকরীতে নিয়োগ বাণিজ্যসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে এই প্রতিবেদক। তাবে, বারবার কল করলেও তিনি কলটি রিসিভ করেননি। এক সময় তিনি নিজের ফোন বন্ধ করে দেন।

নয়াশতাব্দী/একে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ