ছাত্র-জনতার অভ্যত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে সরকার গঠন করা হয়।

আজ রোববার (৮ সেপ্তেম্বর) সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ মাস পূর্ণ হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী, একজন আছেন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত। মানবাধিকার, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাসহ নানান ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকার।

এক মাসে উল্লেখযোগ্য এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে:

মানবাধিকার

জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার যেসব ফৌজদারি মামলা দিয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত হয় কমিশন। এই সময়ের মধ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদেও স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য সরকার একটি ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অনুরোধে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির সবাইকে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করে দেন।

সংসদ, আদালত-ইসি আগস্টের ৬ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তার আগে ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি মাসের ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

রাজনীতি ৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট বাতিল করা হয় জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন। ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না।

আর্থিক খাত ও দুর্নীতি দমন দেশের ১০ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টির মালিকানা ছিল এস আলম গ্রুপের। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালীদের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন গভর্নর।

প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার ১৯ আগস্ট দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১২ আগস্ট বাতিল করা হয় বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ। পরে তা কার্যকর করা হয়। আবার প্রশাসনে নতুন করে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগও দেওয়া হয়। সব সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১ সেপ্টেম্বর। জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে আনা হয়েছে পরিবর্তন। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে হয়েছে পদোন্নতি। ২৫ ডিসিকে করা হয় প্রত্যাহার।

আইনশৃঙ্খলা জুলাই-আগস্ট গণ–আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী–উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তাসহ এখন পর্যন্ত ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অবৈধ ও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযান।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নির্বাহী আদেশে নয়, বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হবে গণশুনানির মাধ্যমে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০–এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না।

স্বাস্থ্য খাত আন্দোলনে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তা দিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় একটি প্রজ্ঞাপন।

শিক্ষা খাত ১৮ আগস্ট দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়। বিদ্যালয়গুলোতেও শুরু হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষাক্রম নিয়ে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, মাধ্যমিকে আবারও ফিরবে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ। তবে উচ্চশিক্ষায় স্থবিরতা কাটেনি। ইউজিসি চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ খালি রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহ্বান জানান শিক্ষা উপদেষ্টা। এরমধ্যে ২০ আগস্ট সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার।

পরিবেশ রামুর সংরক্ষিত বনে বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় অন্তত ৬৪টি নদী চিহ্নিত করে নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ক্রীড়াঙ্গন ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। ওইদিন বিসিবি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন। একই দিনে বিসিবির সভাপতি হন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

নির্বাহী আদেশ ও সিদ্ধান্ত চলতি মাসের ৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২৯ আগস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ -এর খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এখন থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না।

১৩ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাতিল করা হয় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিনে সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

নয়া শতাব্দী/এসআর