ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ডেসকোতে হরিলুট

দুর্নীতির বরপুত্র জগদীশ চক্র!

প্রকাশনার সময়: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:৫৫ | আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:০০

প্রকৌঃ জগদীশ চন্দ্র মন্ডল। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল)। ডেসকোতে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের দোহাই দিয়ে নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতি বানিজ্যসহ ঠিকাদারদের কাজ ভাগাভাগি করে দেওয়াসহ এমন কোনো অনিয়ম নেই যা তিনি করেননি। যেন হরিলুটের অভয়াশ্রম। তার প্রায় সকল অনিয়মেই দোসর হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান স্বাধীন। এই চক্রটি সদ্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠতার প্রভাব খাটিয়ে লুটে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এই চক্রটি যেন দুর্নীতির বরপুত্র। এমনটাই জানা গেছে বিভিন্ন অভিযোগে।

এমন অনেক অভিযোগ ডেসকোর শীর্ষ পর্যায় ও মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সময়ে পড়লেও ডেসকোতে থাকা শক্তিশালী সিন্ডিকেট কোনোটিরই তদন্ত হতে দেয়নি, ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।

অভিযোগে প্রকাশ, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল-আট বছরে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম, গুলশান, বারিধারা বিওবিবি ভাগের লোড ক্লিয়ারেন্সের ফাইলগুলোর মুভমেন্ট তদন্ত করা হলে অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এ কাজে সিন্ডিকেট নেতা প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলেকে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান স্বাধীন ও এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

আমেরিকান ধর্মতত্ত্ববিদ ফ্রাঙ্ক বুকম্যান বলেছেন, ‘পৃথিবীতে সবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ প্রয়োজনের অতিরিক্ত জাগতিক উচ্চাভিলাষ ও লোভ-লালসা দুর্নীতির কারণ।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের চক্রটি ডেসকোতে নিয়োগ পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সাবেক সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটটি। এ ছাড়া নিয়োগ-পদোন্নতিতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ঘুষবাণিজ্য হিসেবে।

ডেসকোর সব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মূল গডফাদার প্রকৌঃ জগদীশ চন্দ্র মন্ডল নিজের আখের গোছানোর জন্য কিছু প্রকল্প সাবেক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগসাজশে গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো হেডকোয়ার্টার প্রকল্প, এমআইসি প্রকল্প এবং ২ লাখ মিটার ক্রয় প্রকল্প, আন্ডারগ্রাউন্ড উপকেন্দ্র, পূর্বাচল আন্ডার গ্রাউন্ড মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রনালয়ে আব্দুল আলীম চৌধুরী নামক ব্যাক্তির করা এক অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ডেসকো নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের ছত্রছায়ায় একই সংস্থার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান স্বাধীন যোগসাজশে নতুন সংযোগ দিতে জিম্মি করে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। যার অধিকাংশই ইতোমধ্যে দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন। তাছাড়া বহুতল আবাসিক ও বানিজ্যিক ভবনের উচ্চ চাপ ক্ষমতাসম্পন্ন সংযোগকে নিম্মচাপ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থাৎ লোড কম দেখিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। ছাড়পত্র নিতে এই চক্রের দাবিকৃত টাকা দিতে কেউ অপারগতা জানালে সেই গ্রাহককে ডেসকোর অফিসিয়াল লেটারে মোটা অঙ্কের প্রাক্কলন দেখায়। যার ফলে গ্রাহক বাধ্য হয়েই তাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে বাধ্য হয়। একইভাবে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উচ্চ চাপ সংযোগকে নিম্নচাপ সংযোগ দেখিয়ে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা আর বিশাল অঙ্কের রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। গত পাঁচ বছরের লোড ছাড়পত্রের নথি পর্যালোচনায় সরকারের শতাধিক কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রমান মিলবে বলে দাবি অভিযোগে। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নাম ভাঙ্গিয়ে সংস্থায় জগদীশ চন্দ্র মন্ডল পদোন্নতি, বদলী ও নিয়োগ বানিজ্য দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে চালিয়ে গেছেন। তাছাড়া নিজের মনোনীত ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দিয়ে কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি রোধে দুদক দুই ধরনের কার্যক্রম করে থাকে। প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক। প্রতিকারমূলক কার্যক্রম হিসেবে তারা যে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করতে পারেন। আর সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এটা দুদক প্রত্যাশা করতে পারে। তবে শুধু সুপারিশ করা খুব একটা যৌক্তিক নয়।’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান ও সুপারিশ করেই দুদকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। অধিকতর অনুসন্ধান করে কারা এ অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারা জড়িত সেটাও বের করা উচিত। সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। তাহলে দুদকের এ ধরনের কার্যক্রম সফলতা পাবে, মানুষেরও আস্থা ফিরবে।’

ডেসকোতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করা সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর একান্ত আস্থাভাজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পর প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং পরে সরাসরি নির্বাহী পরিচালক বনে যান। অস্বাভাবিকভাবেই হয় এসব পদোন্নতি। ডেসকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রকৌশল বিভাগ। এ বিভাগের মাধ্যমেই সব প্ল্যানিং, ড্রয়িং, ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত ও অনুমোদন এবং প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নির্বাহী পরিচালক হিসাবে প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের ডেসকোতে তার অবদান শূন্য, বরং তার কারণে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। তার এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান স্বাধীন সহ আরো অন্তত: দুইজন প্রকৌশলী। অভিযোগ আছে, ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডল প্রভাব খাটিয়ে তার সিন্ডিকেটের এক সদস্যকে প্রথমে নির্বাহী প্রকৌশলী (উন্নয়ন ও প্রকল্প) ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন ও প্রকল্প) এবং বিতরণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে ভূগর্ভস্থ কেবল লেয়িংয়ের দায়িত্ব দেন।

এখানে উল্লেখ্য, ডেসকো সাড়ে তিন কোটি টাকায় একটি যুগোপযোগী আন্ডারগ্রাউন্ড মাস্টার প্ল্যান করলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও সিন্ডিকেট নেতা প্রকৌঃ জগদীশ চন্দ্র মন্ডল একই কাজ ৩০ কোটি টাকায় অন্য একটি কোম্পানিকে দিয়ে করাচ্ছে। এসব প্রকল্প প্রাক্কলন ব্যয়ের কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

ডেসকোর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের কারণেই মূলত লোকসান বেড়েছে। যদি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে দাবি করা হয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের দামের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেই প্রতিষ্ঠানটির বিপুল লোকসান হয়েছে। তবে এমন বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, এ কারণে কিছু ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা গেছে লোকসান থাকত না। হয়তো সে ক্ষেত্রে মুনাফা কম হতো।

অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের একজন উপদেষ্টা এবং ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জগদীশ চন্দ্র মন্ডল এবং তার সহযোগীদের যোগসাজশে বিভিন্ন সময়ে যোগ্যদের বঞ্চিত করার পাশাপাশি নতুন করে অর্গানোগ্রাম সংশোধন করে আবারও তাদের বঞ্চিত করার পাঁয়তারা করছেন। এই জগদীশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং সদ্য সাবেক আওয়ামী সরকারের আমলের দাপুটে এই নির্বাহী পরিচালক সহ তার সিন্ডিকেট ডেসকোতে এখনো বহাল তবিয়তে বেশ দাপটের সঙ্গেই আছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে এ প্রতিবেদকের গ্রামীন মোবাইল নাম্বারটি ব্লাক লিস্টে রাখেন। পরবর্তিতে একটি টেলিটক নাম্বার দিয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর তার হোয়াটস অ্যাপে এ প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি। অভিযোগ দেখতে ক্লিক করুন-

নয়াশতাব্দী/একে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ